কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন: ভার্টিকাল ফার্মিং এর উলম্ব খামারের ধারণা সাশ্রয় , পুনঃব্যবহার এবং চক্রাকারে ব্যবহার এই তিনটি মৌলিক বিষয়ই হলো এই খামার এবং প্রযুক্তির মূল আকর্ষণ। এই খামারপদ্ধতি স্থায়ীভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ, নিরাপদ উৎপাদন, উৎপন্ন পণ্যের উচ্চমান নিশ্চিত করে এবং উৎপাদিত পণ্য সহজে ভোক্তার কাছে সরবরাহে সহায়তা করে। এধরনের উদ্যোগের একটি সাধারণ উদ্দেশ্য হচ্ছে শহুরে স্বল্প জায়গাগুলোকে বার বার ব্যবহার করা এবং স্থানীয়ভাবে বসবাসকারী মানুষের জন্য সতেজ শাক-সবজি উৎপাদন করা ও দৈনন্দিন খাবারে তা ব্যবহার করা। ফলে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীর মধ্যে যে বিশাল দূরত্ব সেটাও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর পরিবহনের জন্য যে জ্বালানি ব্যবহার হয় তা সংরক্ষণ ও পরিবেশের ওপর চাপ কমানো যাবে। পাশাপাশি আরেকটি সুবিধা হচ্ছে এই অভ্যন্তরীণ চাষের মাধ্যমে স্বল্প পানি ও জ্বালানির ব্যবহার যা মানসম্মত কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার অনুকরণীয়।
উলম্ব খামারের যত সুবিধা
উলম্ব খামারের সুবিধা অনেক। ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ৮০% শতাংশ মানুষ শহরতলীতে বসবাস করবে। তখন দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হবে প্রায় ৩০ কোটি। এই বিপুল পরিমাণ মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানোর জন্য অনেক কৃষি জমির প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে যেমন-নদীভাঙন এবং মানুষের আবস্থান ও কল-কারখানা নির্মাণে ব্যাপক পরিমাণ ভূমি ব্যবহারের দরুন কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষিজমি পাওয়া যাবে না। তাছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপুল পরিমাণ ভূমি ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন শুধু উলম্ব খামার যদি সঠিকভাবে নির্মাণ করা যায়, তবেই কৃষিকাজের জন্য অতিরিক্ত ভূমির চাহিদা মেটাতে পারবে এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা সম্ভব হবে।
দেশে প্রচলিত গতানুগতিক খামারে উৎপন্ন ফসল অপেক্ষা উলম্ব খামারে উৎপন্ন ফসলের পরিমাণ হয় বহুগুণ বেশি। কারণ উলম্ব খামারে সারাবছর ফসল উৎপন্ন করা যায়। ফসলের প্রকৃতি ভেদে উৎপাদনের পরিমাণ হবে ৪-৬ গুণ বেশি। আবার অনেক ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি।প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিরাপদ থাকা এর আরেকটি সুবিধাজনক দিক। প্রচলিত পদ্ধতিতে তথা মাঠের কৃষি ক্ষেত্রে ফসলাদি নানারূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-খরা, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি দ্বারা আক্রান্ত হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়ারও পরিবর্তন ঘটছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে খাদ্যদ্রব্য নিরাপদে রক্ষণাবেক্ষণের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছর এই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে শুধু ক্ষেতের ফসলই নষ্ট হয় না জমির উপরিভাগ ও হাজার হাজার ঘড়বাড়ি, স্থাপনা এবং বনাঞ্চল ধ্বংস হয়। উলম্ব খামারে চাষাবাদ হয় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে খাদ্যোৎপাদনে তেমন অসুবিধা হয় না। প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থায় মৌসুমী ফসল বপনের পর কৃষিক্ষেত্র থেকে বিপুল পরিমাণ কৃষিশ্রমিক প্রত্যাহর করা হয়। ফলে শ্রমিকদের কাজের অভাব হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সারাবছর শ্রমিকের কাজের সুযোগ থাকে। তবে উলম্ব খামারে চাষাবাদ করলে প্রচলিত পদ্ধতির চাষাবাদ তথা জমিতে মই দেয়া, চারা রোপণ, ফসল কাটা এবং কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।
উলম্ব খামার পদ্ধতিতে তুলনামূলকভাবে খুবই কম কৃষিজমি এবং বনভূমি ধ্বংস করে। অধিকন্তু উলম্ব খামার শিল্প বর্ধিত শহরতলীতে বিপুল পরিমাণ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবে। প্রচলিত খামার থেকে কর্মহীন হয়ে যেসব লোকজন কাজের খোঁজে শহরে যায় তাদের উলম্ব খামারেই কাজের ব্যবস্থা হবে। তাই কাজের খোঁজে শহরে বা নগরে যাওয়ার আর প্রয়োজন হবে না। ফলে শহরে বিপুল পরিমাণ মানুষের সমাবেশ হবে না এবং মানুষের চাপ কমবে। এই পদ্ধতি কীট-পতঙ্গ, পশু-পাখির উপদ্রব থেকে ফসল রক্ষা করা যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ইঁদুরের দ্বারাই প্রতিবছর বাইরের কৃষিক্ষেত্রে হাজার হাজার টন ফসল ধ্বংস হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে উলম্ব খামারে ক্ষতিকর কীট-পতঙ্গ, বন্যপ্রাণীর দ্বারা ফসল ধ্বংসের পরিমাণ হয় খুবই কম। তাই বর্তমানে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বিকল্প কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলে বর্তমানে প্রচলিত কৃষিব্যবস্থা সীমিত করা যায়।
উলম্ব খামারে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়। ফলে বাইরে থেকে জ্বালানি সংগ্রহের প্রয়োজন হবে না। প্রয়োজনীয় জ্বালানি খামারেই উৎপন্ন হবে। তাই বাইরে থেকে কোনোরূপ জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন খনিজ তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস প্রভৃতি প্রয়োজন হবে না । উলম্ব খামার ব্যবহারের জন্য অবশ্যই পানির প্রয়োজন হয়। পানি ছাড়া কৃষি চিন্তাই করা যায় না। ট্যাঙ্ক বা আধার নির্মাণ করে তাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। তাছাড়া অগভীর পানির পাম্প ব্যবহার করে খামারের নিচে মাটি থেকে পানি তুলে পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব।
কৃপ্র/ এম ইসলাম