কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ নোয়াখালী জেলার উপকূলীয় চরাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে বারি তিসি-১-এর আবাদ বাড়ছে। লবণাক্ত ও খরাসহিষ্ণু হওয়ায় এ তেলজাতীয় ফসল আবাদে কৃষকরা ঝুঁকছেন বলে ধারণা কৃষিবিদদের। চলতি বছর জেলায় প্রায় ৬০০ হেক্টর জমিতে তিসির আবাদ হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের নোয়াখালী সরেজমিন গবেষণা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ ও হাতিয়ায় মূলত তিসির বাণিজ্যিক চাষ হচ্ছে। এবার জেলায় মোট ৫৯৯ হেক্টর জমিতে স্থানীয় ও বারি জাতের তিসির আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে কোম্পানীগঞ্জে ৩৩৫, সুবর্ণচরে ১৩৫ ও হাতিয়ায় ১২৯ হেক্টর জমি। কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বারি তিসি-১ আবাদ হয়েছে প্রায় ৫০০ হেক্টর। চলতি বছর ৫৭০ টনের মতো তিসি উত্পাদন হতে পারে।
সরেজমিন বিভাগের একাধিক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে নোয়াখালীতে। জেলার উপকূলীয় চরাঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে। লবণাক্ত হওয়ায় সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ ও হাতিয়ার বেশির ভাগ জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। খরাপ্রবণতা ও সেচের পানির অপ্রতুলতাও অনাবাদি থাকার কারণ। ফলে জমিগুলোয় শুধু আমন মৌসুমে স্থানীয় জাতের ধান চাষ ছাড়া অন্য কোনো শস্য বা ফসল আবাদ হয় না। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে গবেষণা ইনস্টিটিউট এসব জমিতে আবাদযোগ্য ধানের পাশাপাশি বিভিন্ন তেলবীজ শস্য উদ্ভাবন করছে। উদ্ভাবিত এসব শস্যের মধ্যে বারি তিসি-১ অন্যতম।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আমির ফয়সাল জানান, লবণাক্ত এলাকার কৃষকরা বছরের বেশির ভাগ সময় অন্য পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। ফলে অনাবাদি পড়েছিল জমিগুলো। ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে জেলার উপকূলীয় অঞ্চলে বারি তিসি-১ চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রথম দফায় পরীক্ষামূলকভাবে বিনামূল্যে আধা কেজি বীজ বিতরণ করা হয় কৃষকদের মাঝে। পরীক্ষামূলক এ কার্যক্রমে মিলেছে সফলতা। যারা একবার তিসির আবাদ করেছেন, তারা নিজের জমির বীজ দিয়ে পরের বছর আবার তিসির আবাদ করেছেন।
চলতি মৌসুমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার গাংচিল নদীর তীরবর্তী জমিতে আবাদের জন্য ২৮ কৃষকের মাঝে বারি তিসি-১-এর বীজ ও সার বিতরণ করেছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা। সেখানে ৮২ একর জমিতে তিসির আবাদ হয়েছে।
আবদুর রহিম (৪০) গত মৌসুমে তিন একর জমিতে বারি তিসি-১ আবাদ করেন। খরচ হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। তিন একর জমি থেকে ফলন পেয়েছেন ১৫ মণ। জমিতে থাকতেই পাইকাররা ফসল কিনে নিয়েছেন। সে বছর ৩০ হাজার টাকার তিসি বিক্রি করেছেন। লাভবান হওয়ায় এবার চার একর জমিতে বারি তিসি-১ আবাদ করেছেন।
মোবাশ্বের আহমদ (৩৫) বলেন, গত বছর চার একর জমিতে বারি তিসি-১ আবাদ করে বেশ ভালো লাভবান হয়েছিলেন। তাই এবার আট একর জমিতে এর আবাদ করেছেন তিনি। তার মতে, সরকারি সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে এ অঞ্চলের লবণাক্ত অনবাদি জমিতে রবি মৌসুমে কৃষকরা বারি তিসি-১ চাষ করে সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারবেন। তিসি বিক্রির জন্য বাজারে যেতে হয় না অধিকাংশ কৃষককে। চাহিদা থাকায় ফসল ঘরে তোলার আগেই কিনে নিয়ে যান পাইকাররা।
জানা গেছে, মেঘনা নদীতে প্রায় ১৫ বছর আগে জেগে ওঠা চরে গড়ে উঠেছে গাংচিলের হাসেম বাজারসংলগ্ন বেড়ির পূর্ব এলাকাটি। চরের জমিগুলো চাষের উপযোগী হয়েছে সাত-আট বছর আগে। কিন্তু লবণাক্ততার কারণে এ জমিতে শুধু আমন আবাদ হতো। এর পর দীর্ঘ সময় অনাবাদি পড়ে থাকে জমিগুলো। চার-পাঁচ বছর আগে কৃষকরা এখানে স্থানীয় জাতের তিসি আবাদ শুরু করেন। তবে ফলন হতো খুব কম। তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা। তাদের পরামর্শে এখন তিসি আবাদ থেকে লাভবন হচ্ছেন কৃষক।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের নোয়াখালী সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আমিনুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় খরাপ্রবণ ও লবণাক্ত এলাকার জন্য টেকসই ফসল ব্যবস্থাপনার উদ্ভাবন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় তারা কৃষকদের বারি তিসি-১ আবাদে উদ্বুদ্ধ করছেন। উপকূলীয় লবণাক্ত অঞ্চল খুঁজে বের করে সেখানে কৃষকদের বারি তিসি-১ চাষে আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। সাধ্যমতো প্রণোদনাও দেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, গত কয়েক বছরে তারা সুবর্ণচর, হাতিয়ার উত্তরসহ কোম্পানীগঞ্জের বেশকিছু অংশ বারি তিসি-১ আবাদের আওতায় এনেছেন। সরকারিভাবে আরো বড় কোনো প্রকল্পের সুযোগ হলে কৃষকদের আরো বেশি সহযোগিতা করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/এম ইসলাম