কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ নারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়া থেকে সোনারগাঁওয়ের অলিপুরা বাজার সেতুর দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত নাব্যতা কমে যাওয়া ও ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ সংকটে ব্রহ্মপুত্র নদের দুই তীরে হাজার হাজার বিঘা জমি পতিত হয়ে পড়েছে। তার ওপর যুক্ত হয়েছে সেচসহ কৃষি উপকরণের খরচ বৃদ্ধি ও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। এসব কারণে কৃষকরা ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন ইটভাটায়। এ প্রবণতা বন্ধ করতে এবং ধান চাষে কৃষককে আগ্রহী করে তোলার জন্য উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ, প্রণোদনা প্রদান ও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগেও বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া থেকে সোনারগাঁওয়ের মহজুমপুর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের দুই তীরে বোরো ধানের চাষ হতো। কিন্তু এখন কলাগাছিয়া থেকে সোনারগাঁওয়ের অলিপুরা বাজার সেতুর দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত কয়েক হাজার বিঘা জমি পতিত হয়ে পড়ে আছে। জমিতে সেচের জন্য পানির অভাব, কৃষি উপকরণ ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণেই স্থানীয় কৃষকরা আর ধান চাষ করছে না। ফলে সংসারের ব্যয় মেটাতে গিয়ে এ অঞ্চলের অনেকে বোরো আবাদের বদলে জমির মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দিচ্ছেন। আবার অনেক কৃষক জমিতে গবাদিপশুর জন্য ঘাসের আবাদ করছেন।
কৃষকরা জানান, লোরিক পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভের পানি তুলে জমিতে সেচ দিতে গেলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া অনেক জায়গায় পাম্প বসিয়েও ভূগর্ভের পানি পাওয়া যাচ্ছে না।নদের তীরবর্তী কাইকারটেক এলাকার কৃষক জসিম উদ্দিন, বাবর আলী, ইমন হোসেনসহ কয়েকজন জানান, ব্রহ্মপুত্র তীরে তাদের প্রায় পাঁচ একর জমি রয়েছে। তিন বছর আগেও এসব জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হতো। কিন্তু সেচ দিতে না পারায় সে জমি এখন পতিত পড়ে আছে।
তারা বলেন, আগে ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে পানি তুলে স্বল্প খরচে জমিতে সেচ দেয়া যেত। কিন্তু দুই বছর ধরে নদে আগের মতো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। নদের অনেক স্থানে চর জেগে উঠছে। এতে পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদ খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনলে ধান চাষ আবার শুরু হবে বলে মনে করছেন তারা। রহমত উল্লাহ নামের আরেক কৃষক জানান, কাইকারটেক থেকে লাঙ্গলবন্দ সেতুর নিচ পর্যন্ত জমিতে আগে গভীর নলকূপ খনন করে সেচ দেয়া হতো। এতে খরচ বেশি পড়ে। পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি বেশি হওয়ায় ধান চাষ করে লাভ হয় না।
তবে এ এলাকার উত্তরে সোনারগাঁওয়ের অলিপুরা বাজার থেকে মহজুমপুর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদের দুই তীরের চিত্র ভিন্ন। ২০০৪ সালের শেষের দিকে সরকার ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে পানি ধরে রাখার জন্য রাবার ড্যাম নির্মাণ করে। জোয়ারের সময় ড্যাম ফুলিয়ে উত্তর পাশে পানি ধরে রাখা হয়। ফলে ওই এলাকার কৃষকরা জমিতে স্বল্প খরচে সেচ দিতে পারছেন।
অলিপুরা বাজারের কৃষক সোলেমান মিয়া জানান, একসময় আমাদের অবস্থাও দক্ষিণ পাশের মতোই ছিল। পানির অভাবে জমিতে সেচ দিতে পারতাম না। কিন্তু রাবার ড্যাম নির্মাণ হওয়ার পর থেকে এখন আর সমস্যা হয় না। তবে কলাগাছিয়া থেকে মহজুমপুর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র নদ খনন করা হলে আশপাশের হাজার হাজার পতিত জমিতে আবার ধান চাষ করা যাবে বলে জানান তিনি।
নারায়ণগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্বাস উদ্দিন বলেন, আগে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে প্রচুন ধান চাষ হতো, এটা ঠিক। কিন্তু অলিপুরা বাজার সেতুর দক্ষিণ পাশে এখন চাষ হচ্ছে না। ক্রমাগত নদের তলদেশে পলি জমে নাব্যতা কমে গেছে। আবার কোথাও কোথাও ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। ফলে মাঘের শেষ ভাগ থেকে চৈত্র পর্যন্ত নদের দুই তীরে সেচের জন্য পানি পাওয়া যায় না। কখনো কখনো অতিবৃষ্টির কারণে ফসল তলিয়ে যায়। অনেক সময় কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পান না। আবার ধান কাটার মৌসুমে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এতে মজুরিও বেড়ে যায়। এসব কারণে এ এলাকার কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তবে রাবার ড্যাম স্থাপনের পর থেকে উত্তর পাশে ধান চাষ বেশ ভালো হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কৃষিবিদ সুখরঞ্জন দাস জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে হাজার হাজার বিঘা জমি পতিত পড়ে থাকার মূল কারণ সেচ দিতে না পারা। প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্রহ্মপুত্র নদে খনন জরুরি হয়ে পড়েছে। নদের উপরিভাগের পানি ব্যবহার করতে পারলে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমে আসবে। এতে কৃষক স্বল্প খরচে জমিতে সেচ দিতে পারবেন।
তিনি আরো বলেন, কৃষি সম্প্রসারণের জন্য সরকারের যে সব সংস্থা বা বিভাগ জড়িত, তাদের উচিত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদের ধান চাষে আগ্রহী করে তোলা। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আলাপ-আলোচনায় এ বিষয়গুলো বেশি বেশি ফোকাস করা প্রয়োজন, যাতে কৃষক চাষে আগ্রহ হারিয়ে না ফেলেন। পাশাপাশি ধান চাষের মৌসুমে প্রণোদনা প্রদান এবং ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের যেসব বিভাগ ফসল ক্রয় করে, তাদের এ বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
জমির মাটি বিক্রি সম্পর্কে তিনি বলেন, মাটি বিক্রি থেকে কৃষককে বিরত রাখতে হবে। কারণ পলি হচ্ছে জমির প্রাণ। পলি মাটি বিক্রি করে দিলে জমির উর্বরতা হারিয়ে যাবে। তখন জমিতে আর ফসল ভালো হবে না। মাটি বিক্রি বন্ধে প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/এম ইসলাম