‘মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের গুরুত্ব’
কৃষিবিদ মো. আল-মামুন: বাংলাদেশকে সোনালি অাঁশের দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দিয়েছে পাট। স্বাধীনতার পরে পাট ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় পরিবেশবান্ধব তন্তু হিসেবে এবার পাটের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকায় । পাট ও পাটপণ্য শুধু পরিবেশবান্ধব এবং সহজে পচনশীলই নয় এটা পরিবেশকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। পরিবেশ রক্ষায় এবং স্বাস্থ্য উন্নত হাইড্রোকার্বন মুক্ত জুট বেস্নচিং ওয়েল উন্নয়ন, জুট ফাইবারকে বিশেষ রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে অগি্নরোধী পাটজাত বস্ত্র উৎপাদন, পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগের বিকল্প স্বল্পব্যয়ে পাটের ব্যাগ তৈরি এবং দেশের নার্সারিগুলোয় গাছের চারা সংরক্ষণে পাটের ব্যাগ (নার্সারি পাট) উদ্ভাবন করেছেন বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয় সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল।
জিওটেক্সটাইল ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড় ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকার। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, রেল, সড়কসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অবকাঠামো তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল হিসেবে জিওটেক্সটাইলের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বজুড়ে নানা কাজে ‘মেটাল নেটিং’ বা পলিমার থেকে তৈরি সিনথেটিক জিওটেক্সটাইলের পরিবর্তে পরিবেশ উপযোগী ও উৎকৃষ্ট জুট জিওটেক্সটাইলের কদর বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনসুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টসশিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া ইউরোপের বিএমডাবিস্নউ, মার্সিটিজ বেঞ্চ, ওডি ফোর্ড, যু্ক্তরাষ্ট্রের জিএম মটর, জাপানের টয়োটা, হোন্ডা কোম্পানিসহ নামিদামি সব গাড়ি কোম্পানিই তাদের গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ও ডেশবোর্ড তৈরিতে ব্যবহার করছে পাট ও কেনাফ। বিএমডাবিস্নউ পাট দিয়ে তৈরি করছে পরিবেশসম্মত ‘গ্রিন কার’ যার চাহিদা এখন প্রচুর।
। পাট ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘প্লাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির ওপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলী ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, পাট ফসল উৎপাদনকালে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাটপাতা মাটিতে পড়ে। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, ক্যারোটিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এ ছাড়া পাট ফসল কর্তনের পর জমিতে যে পাটগাছের গোড়াসহ শিকড় থেকে যায় তা পরে পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সার যোগ করে, এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে। প্রতিবছর গড়ে ৯৫৬.৩৮ হাজার টন পাটপাতা ও ৪২৩.৪০ হাজার টন পাটগাছের শিকড় মাটির সঙ্গে মিশে যায়, যা জমির উর্বরতা ও মাটির গুণগত মান বৃদ্ধিতে ব্যাপক প্রভাব রাখে। এ কারণে যে জমিতে পাটচাষ হয়, সেখানে অন্যান্য ফসলের ফলনও ভালো হয়।
পৃথিবীজুড়ে প্রতি মিনিটে ১০ লাখেরও বেশি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিক ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরিতে প্রতিবছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪% ব্যবহৃত হয়। প্লাস্টিক ব্যাগ জৈব বিয়োজনশীল নয়। এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন প্লাস্টিক ব্যাগ পোড়ালে বতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ ও ১৩৪০ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড মেশে। এসব ক্ষতিকারক বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কজাত করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।
সাম্প্রতিককালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সিনথেটিক ব্যাগসহ পরিবেশ বিনাশক অন্যান্য উপাদানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঝুঁকে পড়ছে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের দিকে। এ ক্ষেত্রে পাটই হয়ে উঠেছে বিকল্প অবলম্বন। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ইতালি। অথচ তারা ছিল পৃথিবীর সর্বাধিক প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারকারী দেশ। প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দেশের মধ্যে আছে ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকাসহ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন রাজ্য। এ তালিকা প্রতিবছরই বাড়ছে। ওয়ালমার্ট, টেসকোর মতো বৃহৎ চেইন শপগুলো পাটের ব্যাগ ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিখ্যাত চেইন শপ টেসকোর প্রতিমাসে ১ মিলিয়ন প্রাকৃতিক অাঁশের তৈরি ব্যাগের প্রয়োজন। এ ব্যাগ তারা প্রধানত ভারত থেকে আমদানি করছে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রতিমাসে ১ লাখ পাটের ব্যাগ রপ্তানি করা হয়। সম্প্রতি পাট ও পাটজাত বর্জ্যের সেলুলোজ থেকে পরিবেশবান্ধব পলিব্যাগ উদ্ভাবন করেছে পরমাণু শক্তি কমিশন, যা দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই মাটিতে মিশে যাবে। ফলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়েয় হিসাব মতে শুধু ঢাকাতেই মাসে প্রায় ৪১ কোটি পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে প্রতিবছর ১ ট্রিলিয়ন মেট্রিকটন পলিথিন ব্যবহার করা হয়, যার ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার ১০ লাখেরও বেশি পাখি এবং লক্ষাধিক জলজ প্রাণী।
বাংলাদেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পাটশিল্পকে সুরক্ষা দিতে গত বছর ৪ জানুয়ারি সর্বোচ্চ ৩ বছরের জেল, ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ে দ-িত করার বিধান রেখে পাট আইন-২০১৬ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এর ফলে পাটজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকার বস্তা ব্যবহৃত হয়েছে।
সম্প্রতি সরকার ধান, চাল, গম, ভুট্টা, চিনি ও সারের সঙ্গে আরও ১১টি পণ্যের সরবরাহ ও বিতরণে কৃত্রিম মোড়কের ব্যবহারজনিত কারণে সৃষ্টি পরিবেশ দূষণরোধকল্পে বাধ্যতামূলকভাবে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারি/বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের মোড়ক হিসেবে ৭৫ শতাংশ পাট আছে এমন উপাদান দিয়ে তৈরি মোড়ক ব্যবহারের বিধান রাখা হয়েছে। পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন-২০১০ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা গেলে দেশে বার্ষিক পাটের ব্যাগের চাহিদা ৯০ হাজার পিস থেকে বেড়ে ৮৪ কোটি পিসে উনি্নত হবে। এতে ৫৩,৯,২০০ টন পাটের অাঁশের প্রয়োজন হবে যা দেশের মোট পাট উৎপাদনের ৭৭ শতাংশ।
ধারণা করা হচ্ছে, পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যবহার আগামী দু্ই থেকে তিন বছরের মধ্যেই সারা বিশ্বে তিনগুণ বেড়ে যাবে। ফলত পাটপণ্যের বাজারই সৃষ্টি হবে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়নের। দুনিয়াব্যাপী পাটের ব্যাগের চাহিদা বৃদ্ধি ও আমাদের দেশের উন্নতমানের পাট এ দুই হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশেরও সফলতা আসতে পারে। পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এই আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই।
এ দেশের মান্ধাতার আমলের পাটকলগুলোকে আধুনিকীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ খাতে সম্ভাবনাকে কাজে লাগতে হলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিতে হবে এবং ছোট কারখানাগুলোকে সমবায়ের মাধ্যমে বড় আকারের উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে। পাটচাষ থেকে পাটপণ্য উৎপাদন, বিক্রয় ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। সেজন্য সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য পাটের মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে তা অতি দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ, বিজেআরআই, ঢাকা।/ কৃপ্র/এম ইসলাম