মো. নজরুল ইসলাম: তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সবগাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতো বহুবিধ গুণে গুণান্বিত তালগাছের কথাই বলছি। এ বৃক্ষটি অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের মানুষের রক্ষাকবচ। কবিগুরু লিখেছিলেন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তালের টুপি পরতেন। হাত পাখার শীতল বাতাস থেকে শুরু করে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর হার কমানোর প্রধান সহায়ক তালগাছ। থাইল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেও ৬৪ জেলায় তালগাছ রোপণ করে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমাতে পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
দুই দশক আগে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জের আনাচে-কানাচে শোভা পেত অসংখ্য তালগাছ। জনশ্রুতি আছে তালগাছে বজ্রপাত হয় বলে নিধন হতে হতে এখন বিলুপ্তপ্রায়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তালগাছের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চৈত্রের প্রচ- খরতাপে তালের কচি শাঁস, তালগাছের পাতায় ঝুলে থাকা কারিগর পাখি বাবুইয়ের বাসা, তালপাতার হাত পাখার শীতল বাতাস, ভাদ্র মাসের তালের পিঠা এখন প্রায় অতীত।
টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে নিজ উদ্যোগে তালগাছ লাগিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন একজন প্রকৃতিপ্রেমী বিজ্ঞানী আব্দুল আজিজ কোম্পানি। পুরনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তার এই অনন্য উদ্যোগ। আজিজ তার বসতভিটার ৮ একর জমিতে চারদিকে তালগাছের বেষ্টনী দিয়ে সাজিয়ে দেখিয়েছেন।
ইতোমধ্যেই নিজ খরচে ঘাটাইল, মধুপুর, ফুলবাড়িয়া, জামালপুরের কিছু অংশে রাস্তার ধারে, নদী বা বিলের পাড়, খালের ধার, বীজের দুই পাশে গত ২০ বছরে এক লক্ষাধিক তালের আটি রোপণ করেছেন। আজিজ নিজের গ্রাম শালিয়াবহ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী প্রায় অর্ধশত গ্রামের রাস্তার খালের পাড়ে, রাস্তার দুই পাশে সারি সারি তালগাছ শোভা পাচ্ছে। আজিজের কাছে প্রেরণা পেয়ে সিলেটের সুনামগঞ্জের জিল্লুর রহমান নিজের ২০ একর জমিতে তালগাছের বেষ্টনী দিয়েছেন। প্রকৃতিপ্রেমী আজিজের এ কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৮ সালে জেলা পরিষদ কর্তৃক সাদা মনের মানুষ এবং ২০১০ সালে চ্যানেল আই কৃষি পদক পুরস্কারে ভূষিত হন।
কেন এমন উদ্যোগ নিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মাথায় তালের পাতার অাঁশ দিয়ে বানানো টুপি ব্যবহার করতেন সেটি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে তালগাছ নিয়ে ভাবতে থাকেন। আজিজ বলেন, ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে আমার মাথায় এ ভাবনা আসে। আমি নিজে তালের পাতার অাঁশ দিয়ে বানানো টুপি পরে দেখলাম, বুঝতে পারলাম এ টুপি তাপ প্রতিরোধ করে মাথা ঠা-া রাখে। শুধু তাই নয়_ তালগাছের কোনো অংশই ফেলনা নয়। তালগাছ অনেক দিন বাঁচে, অন্য ফসলের কোনো ক্ষতি করে না, মাটির ক্ষয় রোধ করে, তালগাছ ঘর তৈরির উত্তম কাঠ, গাছের ডালের গোড়ার অংশ সেদ্ধ করে যে অাঁশ পাওয়া যায় তা অত্যন্ত উন্নতমানের তন্তু, জ্বালানি হিসেবেও এর চাহিদা অনেক। স্ত্রী ও পুরুষজাতীয় তালগাছ একটানা ৯০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত দিনে ১২ থেকে ১৫ কেজি রস দেয়, যার পাঁচ কেজি রস থেকে এক কেজি উন্নতমানের গুড় তৈরি করা যায়। তালের রসের গাদ উচ্চমানের মাছ ও গরুর খাবার। তালের অাঁটির উপরি অংশে সুতা খোসা মোজাইক পাথরের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তা ছাড়া তালের রস উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ সু-স্বাদু খাবার।
আজিজ বলেন, বসতভিটা থেকে নিরাপদ দূরত্বে প্রতি বিঘা জমিতে চারটি করে তালগাছ রোপণ করলে বজ্রপাতসহ নানা দুর্যোগ মোকাবেলা সম্ভব। বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে কাঁটাতারের বেড়া না দিয়ে ছয় ফুট দূরত্বে আড়াআড়ি তিনসারি করে তালগাছ রোপণ করলে যেমন সীমানা প্রাচীর হবে অন্যদিকে যুদ্ধগাড়ি ট্যাঙ্কসহ ভারী যানবাহন প্রবেশ করতে পারবে না। তা ছাড়া বন্যহাতির অনুপ্রবেশ ঠেকানো সম্ভব। যেহেতু তালগাছ লবণাক্ত পানিতে মরে না, তাই সমুদ্র তীরবর্তী ভূমিতে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও মাটিক্ষয় রোধে তালগাছ লাগানো যেতে পারে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বজ্রপাতে ৬৯১ জন মৃত্যুবরণ করেছে। ২০১৬ সালে ১২ মে ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে বজ্রপাতে ৬২ জনের মৃত্যু হয়। ওই সময় সরকার বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগের অন্তর্ভুক্ত করে। বিগত বছর বজ্রপাতে প্রায় ২০০ জন মানুষ মারা যায়। এ সময় সারাদেশে প্রচুর গবাদিপশুও মারা যায়। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কমানোর তাগিদে সরকার দেশব্যাপী ১০ লাখ তালগাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বজ্রপাত ঠেকানোর সবচেয়ে কার্যকর স্থানীয় প্রযুক্তি হিসেবে এই পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আসাদুল হকের মতে, বজ্রপাত যেহেতু উঁচু জায়গায় আঘাত করে, সে হিসেবে বজ্রপাত আগে তালগাছে পড়ে ফলে লোকালয়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা কমায়। আজিজ কোম্পানি মনে করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার পক্ষে এ কাজটি করা আরও সহজ হবে।
সুত্র, যায়যায় দিন / কৃপ্র/এম ইসলাম