কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় গত ২০১৫ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে সম্পাদিত বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। ঐতিহাসিক এই চুক্তিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির গড় হার দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে বা সম্ভব হলে দেড় ডিগ্রির মধ্যে রাখতে বিশ্বের দেশগুলো একমত হয়। চুক্তিতে সমর্থন দিয়েছে বিশ্বের ৪০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দুই দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আর এতে বড় ভূমিকায় ছিল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বিশ্বের ১৮০টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থ সহায়তা দেওয়া। চীন এই চুক্তির বাস্তবায়নে অঙ্গীকার করে। প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমর্থনকে স্বাগত জানিয়েছিল পরিবেশবাদীরা। তারা বিশ্বনেতাদের এই প্রচেষ্টাকে যুগান্তকারী বলে উল্লেখ করে।
সবকিছু প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোচ্ছিল। কিন্তু এখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! যিনি বিশ্বাস করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে মানুষের কোনো হাত নেই। তাই তিনি আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট হলে এই জলবায়ু চুক্তি থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেবেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছেন। ওবামার জলবায়ু নীতিতে ব্যাপক কাটছাঁট করেছেন। গত ২৮ মার্চ তিনি ওবামার জলবায়ু নীতির গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ‘ক্লিন পাওয়ার প্ল্যান’সহ অন্তত ছয়টি পদক্ষেপ বাতিল করে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন। এর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ-বিরোধীসহ ছয়টির বেশি পদক্ষেপ বাতিল হয়ে গেছে। আদেশে স্বাক্ষর করার আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, এর মাধ্যমে কয়লাবিরোধী যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল এবং চাকরির বাজার সৃষ্টি হবে।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র কার্বণ নিঃসরণের অঙ্গীকার করেছিল। ওবামার ক্লিন পাওয়ার প্ল্যানের (সিপিপি) গ্রিন রুল কার্বন নিঃসরণে সহায়ক ছিল। ওই নীতি অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণে নিরুত্সাহিত করার কথা বলা ছিল। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এমনকি সরকারি জমিতে কয়লা উত্পাদন এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণে অনুমতি না দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল। এই পদক্ষেপকে ওবামার ‘কয়লাবিরোধী যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্প। ওবামার নীতি রিপাবলিকান পরিচালিত রাজ্যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল। বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এসব ব্যবসায়ীরা কয়লা, তেল এবং গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। গত বছর সুপ্রিম কোর্ট সাময়িকভাবে এই পরিকল্পনা স্থগিত করেছিল।
ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, নতুন নীতিতে কাজের ক্ষেত্র যেমন বাড়বে, তেমনি জ্বালানি আমদানিও কমে যাবে। ব্যবসায়ীরা তার পদক্ষেপের প্রশংসা করলেও পরিবেশবাদীরা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা সতর্ক করে বলেছে, এই পদক্ষেপ দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র যে অঙ্গীকার করেছিল তা নতুন আদেশে ভঙ্গ হবে। পরিবেশবাদীরা আইনের আশ্রয় নেওয়ার হুমকি দিয়ে বলেছে এই ধরনের নির্বাহী আদেশে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অর্থহীন হয়ে পড়তে পারে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়া এবং জাতিসংঘের বিজ্ঞান প্যানেলের সাবেক প্রধান প্রফেসর স্যার রবার্ট ওয়াটসন বলেন, তথ্য-উপাত্ত মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্য জলবায়ুতে প্রভাব পড়ছে, সেখানে ট্রাম্প প্রশাসন ও কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ রিপাবলিকান নেতারা বালুর নিচে তাদের মাথা গুঁজে রাখছেন।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের পর বিশ্বব্যাপী হত্যাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নির্বাহী আদেশকে প্যারিস চুক্তি ভঙ্গের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছে চীন। এই প্রেক্ষাপটে বেইজিং আশঙ্কা করছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম রাখার ঐতিহাসিক অঙ্গীকার থেকে সরে আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তারা জানিয়েছে, তেমন ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রের ওই অঙ্গীকারের দায় চীন নেবে না। চীনের এই প্রতিক্রিয়ার পর আরো সংশয়ের মধ্যে পড়েছে জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের প্যারিস অঙ্গীকার।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস-এর এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কাজে নেতৃত্ব দেওয়াটা চীনের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। এ লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণ না করলে যে শূন্যস্থান তৈরি হবে তা বেইজিং পূরণ করবে না। ওই সম্পাদকীয়তে বলা হয়, পরিবেশ রক্ষায় ওয়াশিংটনের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনই সে অঙ্গীকার প্রথম ভঙ্গ করতে পারে, যা হতাশাজনক। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ট্রাম্প প্রশাসনকে পশ্চিমা জনমতের পক্ষ থেকে চাপ দিয়ে যেতে হবে। ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক স্বার্থপরতাকে অবশ্যই নিরুত্সাহিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের মতে, ট্রাম্পের আদেশের ফলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ২৬ থেকে ২৮ শতাংশ কমানোর যে অঙ্গীকার করেছিল, ট্রাম্প কয়লাভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র চালু করলে সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কঠিন হবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল দুই অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া ও নিউইয়র্কের কর্তৃপক্ষ বলেছে, তারা পূর্বের জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের নীতিতে অটল থাকবে। ক্যালিফোর্নিয়ার কর্মকর্তারা এ বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। ফ্রান্সের রাজনীতিক লরো ফাবিউস ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে সভাপতি ছিলেন। তিনি ট্রাম্পের পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছেন, এটা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াইকে পিছিয়ে দেবে।
পৃথিবীর সুরক্ষার স্বার্থে প্রায় ২০০টি দেশ ওই চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে একমত হয়েছে। যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। কিন্তু তার বিদায়ের পর উত্তরসূরি এ ক্ষেত্রে বিপরীত পথে হাঁটবেন এমন আগে কেউ কল্পনাও করেননি। জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণে রেখে এই গ্রহকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য রাখা সত্যিই এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
সুত্রঃ ইত্তেফাক/ কৃপ্র/এম ইসলাম