কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ মাদারীপুর জেলার ১৪০ কিমি খরস্রোতা নদ-নদী শুকিয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এসব নদ-নদী ধীরে ধীরে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে জেলার নদী বন্দর ও লঞ্চঘাটগুলো। ফলে ভাটা পড়েছে ব্যবসা বাণিজ্যে। এক সময় নদ-নদী আর বিল-বাঁওড়ের জনপদ হিসেবে খ্যাত ছিল মাদারীপুর। পদ্মা, আড়িয়ালখাঁ, নিম্নকুমার, ময়নাকাটা ও পালরদী এ জেলার প্রধান নদ-নদী। এছাড়া বাঘিয়ার বিল, লখন্ডার বিল, পিতাম্বর বিল, শশীকর বিল, গৈদির বিল, জয়ার বিল, জুয়ারিয়ার বাঁওড়, পাঁচখোলার বাঁওড়, বিল পদ্মার মতো বড় বড় বিল বাঁওড় ছিল জেলার সম্পদ। এসব নদ-নদী, বিল বাঁওড় শুকিয়ে বর্তমানে সব খালে পরিণত হয়েছে।
মাদারীপুরে নদ-নদীকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছিল বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দেশী-বিদেশী বৃহৎ কোম্পানিগুলো এখানে ব্যবসা করতে এসেছে। তখন আড়িয়ালখাঁ নদীর তীরে প্রাচ্যের দ্বিতীয় ডান্ডি হিসেবে খ্যাত চরমুগরিয়া বন্দর ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির প্রধান কেন্দ্র। এখানে বাণিজ্য করতে এসেছে বিড়লা, ইস্পাহানি, গজরাজ, বসরাজ, পান্নালাল, সরজ মল, নাগর মল, চুনিলাল আগরওয়ালার মতো বড় বড় কোম্পানি ও ব্যবসায়ী। তখন ব্রিটিশ, ইউরোপ, ভারত, চায়না, জাপান থেকে বড়-বড় জাহাজ এসে নোঙ্গর করত চরমুগরিয়া বন্দরে। আড়িয়ালখাঁ ও কুমার নদের মোহনায় রাশিবাবু বাজারে ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে অন্যতম স্টিমার ঘাট। এই স্টিমার ঘাট থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যবোঝাই করে অস্টিচ, মেঘলা, শিউলী, কিউই, লালি, সান, সাগরের মতো বড় বড় জাহাজ ছেড়ে যেত বিদেশের উদ্দেশ্যে। শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যই নয় জেলার যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌপথ।
চল্লিশের দশকেও মানুষের যাতায়াতের জন্য জেলায় কোন সড়কপথ ছিল না। পদ্মা, আড়িয়ালখাঁ, কুমার, ময়নাকাটা ও পালরদী ছিল স্টিমার, লঞ্চ ও নৌকা চলাচলের সচল নৌরুট। অর্থাৎ নদ-নদীগুলো ছিল এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণ। এসব উত্তাল-খরস্রোতা নদ-নদী পাড়ি দিতে পাকা মাঝি-মাল্লাদেরও বুক দুরুদুরু করে কাঁপতো। নদ-নদীর পাশাপাশি এ জেলার বিল-বাঁওড় ছিল যাতায়াত, উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ও মৎস্য সম্পদের ভা-ারের জন্য বিখ্যাত। সবই ছিল এ জেলার নদ-নদীকে ঘিরে।
চল্লিশের দশকের পর থেকে শুরু হয় ভাঙ্গা গড়ার খেলা। এ ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় এবং প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবে ধীরে-ধীরে খর¯্রােতা নদ-নদীগুলো শুকিয়ে বালুচরে পরিণত হতে থাকে। যার কোনটা অস্তিত্ব সংকটে আবার কোনটা সরু খালে রূপান্তরিত হয়েছে। পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকে জেলার নদ-নদীগুলো শুকিয়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। একইসঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় আড়িয়ালখাঁর তীরের চরমুগরিয়া নদী বন্দর, শিবচরের শিবচর ও উৎরাইল নদী বন্দর, কুমার নদের তীরের টেকেরহাট নৌবন্দর, ময়নাকাটা নদীর তীরের বরহামগঞ্জ, চান্দেরচর, উমেদপুর, পালরদি নদীর তীরের তালতলা, ফাঁসিয়াতলা, কালিগঞ্জ, ঝুরগাঁও, সাহেবরামপুর, সিডিখান, আড়িয়ালখাঁর তীরের সন্ন্যাসীরচর, নাওডোবা, বহেরাতলা, খাশেরহাট, ভাদুরী, আউলিয়ারচর, কালিকাপুর, ছিলারচর, লক্ষ্মীপুর, শেখপুর, খেজুরতলা, মাদ্রা, ফরাজীরহাট, গোবিন্দপুর, খোয়াজপুর, মহিষেরচর, জাজিরা, ভারীকান্দি, নাওয়াড়া, হোগলপাতিয়া, জাফরাবাদ, ধুরাইল লঞ্চঘাটগুলো।
ষাটের দশকে পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে শিবচর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় চরজানাজাত ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়ন। এছাড়া মাদবরেরচর ও বন্দরখোলা ইউনিয়নের বড় একটা অংশ পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে পদ্মার বুকে জেগে ওঠে বিশাল চর যা চরজানাজাত ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়ন। গড়ে ওঠে জনবসতি। সেই থেকে পদ্মানদী মাদারীপুর অংশ দু’টি সরু খালে পরিণত হয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় বয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে ড্রেজিং করে কোন রকমে নৌ-চলাচল সচল রাখা হচ্ছে।
সুত্রঃ জনকণ্ঠ / কৃপ্র/এম ইসলাম