কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ গবাদিপশুর মধ্যে ভোলায় মহিষ পালন বেশ জনপ্রিয়। জেলার অধিকাংশ খামারি মহিষ পালন করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মহিষের দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য ভোলার অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। কিন্তু প্রয়োজনীয় ঘাস আর মিঠা পানির অভাবে মহিষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন রোগ। চারণভূমিতে লবণ পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী ভোলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে ৯১ হাজার মহিষ রয়েছে। প্রতিদিন এসব মহিষ থেকে প্রায় ৩০০ টন দুধ উত্পাদন হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, লোকালয়ে ঘাসের অভাব থাকায় বিভিন্ন বনাঞ্চলের চারণভূমিতে পালন করা হয় মহিষ। কিন্তু সম্প্রতি বাথান এলাকায় লবণ পানি প্রবেশ করায় ঘাস আর মিঠা পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। লবণাক্ত পানি খেয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এরই মধ্যে বহু মহিষ মারা গেছে।
গবাদিপশু নিয়ে গবেষণাকারী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থা’র মতে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের খাদ্যের অভাবসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে জেলায় ১৪ শতাংশ মহিষ মারা গেছে। সর্বশেষ গত তিন মাসে জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে ৪০টিরও বেশি মহিষ মারা গেছে। এছাড়া প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাবে মহিষের শরীর দুর্বল থাকায় সামান্য জোয়ারের পানিতেই শত শত মহিষ ভেসে যায় এক চর থেকে আরেক চরে। ভেসে যাওয়া এসব মহিষের মধ্যে কখনো দু-একটি জীবিত পাওয়া গেলেও অধিকাংশ মহিষেরই কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না।
স্থানীয়রা জানায়, একসময় চরাঞ্চলে ঘাসের কোনো অভাব ছিল না। এখন প্রতিটি চরের মাটিতে বালি জমে থাকায় নতুন করে ঘাস জন্ম নিচ্ছে না। তাছাড়া সাগরের লোনা পানি নদীসহ লোকালয়ের প্রতিটি খাল-বিলে প্রবেশ করছে। এতে মিঠা পানির অভাবে চরাঞ্চলে থাকা মহিষের মধ্যে ছড়াচ্ছে বিভিন্ন রোগ। অনেক সময় সঠিক চিকিত্সার অভাবেও বহু মহিষ মারা গেছে। চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর ইউনিয়নের খামারি ছালাম পাটওয়ারী বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর আগে চরে মহিষ পালন শুরু করেছি। বর্তমানে আমার ২৩০টি মহিষ আছে। আগে চর এলাকায় ঘাসের কোনো অভাব ছিল না। তাই মহিষের সংখ্যা বেশি হলেও পালনে কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো না। কিন্তু সম্প্রতি চরে ঘাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এক চর থেকে মহিষ আরেক চরে নিয়েও চাহিদা অনুযায়ী ঘাস পাওয়া যায় না। তাই ঘাসের অভাবে মহিষের শরীর-স্বাস্থ্য কমে যাওয়ার পাশাপাশি দুধ উত্পাদনও কমছে।’
ফারুক মিয়া নামে আরেক খামারি বলেন, ‘মনপুরার চরকালকিনিতে আমার প্রায় ১৫০ মহিষ রয়েছে। আগে মহিষগুলো থেকে প্রতিদিন ছয়-সাত মণ দুধ পাওয়া গেলেও কয়েক মাস ধরে মহিষের দুধ উত্পাদন একেবারেই কমে গেছে। বর্তমানে দৈনিক দেড় থেকে দুই মণের বেশি দুধ পাওয়া যায় না। কেননা চরে আগের মতো পর্যাপ্ত ঘাস নেই। তাই মহিষগুলো খাবারের অভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে দুধ উত্পাদনেও। তাছাড়া লোনা পানি খেয়ে মহিষের মধ্যে ছড়াচ্ছে বিভিন্ন রোগ। তাই বর্তমানে মহিষ পালন করে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে দ্বিগুণ।
এদিকে আবাসস্থল ও মাটির কিল্লা সংকটে রয়েছে ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের মেঘনা নদীর মাঝে জেগে ওঠা মাঝের চরের প্রায় ২০ হাজার গবাদিপশু। এর মধ্যে মালিকানাধীন মহিষের সংখ্যা রয়েছে ১০-১২ হাজার। তবে এ চরে মহিষের খাদ্যের অভাব না থাকায় লালন-পালনে যোগ হয়েছে বাড়তি সুবিধা। তাছাড়া স্বল্প খরচ ও সামান্য পরিশ্রমেই অধিক মুনাফা অর্জন হওয়ায় অধিকাংশ খামারিই এ চরে মহিষ পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তবে আবাসস্থল সংকট ও মাটির কিল্লা না থাকায় প্রতিদিন জোয়ারের পানিতে মহিষগুলোকে দীর্ঘ সময় গলাভর্তি পানির মধ্যে ডুবে থাকতে হয়। এতে রোগাক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সময় মহিষ মারা যায়।
জেলার মনপুরা উপজেলার বিচ্ছিন্ন উপদ্বীপ চরনিজামে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় মহিষের মালিকরা মিঠা পানি না পেয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের ব্যবহূত পুকুরের পানি মহিষকে খাওয়াচ্ছেন। এভাবে শত শত মহিষের জন্য জনপদের পুকুরের পানি নেয়ায় বর্তমানে পুকুরটি মানুষের ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। ওই পুকুরের দূষিত পানি ব্যবহার করে স্থানীয়রা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
গ্রামীণ জন উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন মহিন বলেন, ‘চরাঞ্চলের চারণভূমিতে পুকুর কেটে মাটির কিল্লা তৈরি করে দিলে অন্তত মহিষের নিরাপত্তা এবং মিঠা পানির অভাব পূরণ হবে। মহিষ পালন চরাঞ্চলের মানুষের কাছে একটি লাভজনক ব্যবসা। তাই এ খাতের সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।’
চরাঞ্চলে মিঠা পানি ও ঘাসের সংকটের কথা স্বীকার করে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, ‘জেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে মহিষ পালনের সুবিধার্থে বেশকিছু মাটির কিল্লা তৈরি করার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আশা করি, এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে একদিকে যেমন মহিষের আবাসস্থল হিসেবে তৈরি হবে মাটির কিল্লা, অন্যদিকে মাটির কিল্লার চারপাশে তৈরি হবে পুকুর। এতে মহিষের খাওয়ার জন্য বিশুদ্ধ পানির অভাব হবে না।’
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম