কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। দেশে বছরে উৎপাদন হচ্ছে ১৯ লাখ টন মাছ। এছাড়া মুরগির মাংস উৎপাদনও সাত লাখ টন ছাড়িয়েছে। উদীয়মান এ দুটি খাতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রাণী খাদ্যের বাজার, যা দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে বিশাল এ বাজারের অর্ধেকেরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে বড় আটটি কোম্পানি।
প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) ও ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ফিআব) সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ১৪০টি নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান প্রাণী খাদ্য (মাছ ও পোলট্রি) উৎপাদন করছে। এসব কোম্পানির মাধ্যমে গত বছরে প্রায় ২৭ লাখ ৯৫ হাজার ৪০ টন প্রাণী খাদ্য উৎপাদন হয়েছে, যার ৫৪ শতাংশই এসেছে বড় আট প্রতিষ্ঠান থেকে। এর মধ্যে ২ লাখ ৯১ হাজার ৩৬০ টন প্রাণী খাদ্য উৎপাদন করে শীর্ষ অবস্থানে আছে ইসলাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আফতাব ফিড প্রডাক্টস লিমিটেড। এর পরই রয়েছে নারিশ পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি। গত বছর ২ লাখ ৮২ হাজার টন প্রাণী খাদ্য উৎপাদন করেছে কোম্পানিটি। ২ লাখ ৭৩ হাজার টন প্রাণী উৎপাদনের মাধ্যমে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে কোয়ালিটি ফিডস লিমিটেড। প্যারাগন পোলট্রি লিমিটেড উৎপাদন করেছে ২ লাখ ৫২ হাজার টন প্রাণী খাদ্য। এছাড়া কাজী ফিডস লিমিটেড ২ লাখ ২৮ হাজার টন, সৌদি বাংলা ফিশ ফিড লিমিটেড ২ লাখ ১৬ হাজার টন, সিপি (বাংলাদেশ) কোম্পানি লিমিটেড ১ লাখ ২১ হাজার ও এসিআই গোদরেজ অ্যাগ্রো প্রাইভেট লিমিটেড ১ লাখ ৯ হাজার ৬৮০ টন প্রাণী খাদ্য উৎপাদন করেছে গত বছর।
এ বিষয়ে ফিআব সভাপতি ও প্যারাগন পোলট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মসিউর রহমান বলেন, পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে গত এক দশকে দেশে মাছ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। এ তিনটির উৎপাদন বাড়াতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়েছে প্রাণী খাদ্যের। ফলে কয়েক বছর ধরেই ১৫ শতাংশের ওপর প্রাণী খাদ্যের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে।
ফিআবের তথ্যানুসারে, প্রাণী খাদ্যের বর্তমান চাহিদার ৫৫ শতাংশের বেশি পোলট্রি খাদ্য। প্রতি কেজি পোলট্রি খাদ্যের দাম ৩৫-৩৭ টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজি পোলট্রি খাদ্যের দাম গড়ে ৩৬ টাকা ধরে নিলে প্রায় ১৬ লাখ টন পোলট্রি খাদ্যের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাজারজাতকৃত মাছের খাবার দুই ধরনের ভাসমান ও ডুবন্ত। মত্স্যখাদ্যের মোট বাজারের অর্ধেকই ভাসমান খাবার। প্রতি কেজি ভাসমান মত্স্যখাদ্যের দাম মান ও কোম্পানিভেদে ৪০-৪২ টাকা। অন্যদিকে ডুবন্ত খাবারের দাম কেজিপ্রতি ৩৫-৩৭ টাকা। সে হিসাবে প্রতি কেজি মাছের খাবারের গড় দাম ৩৮ টাকা ৫০ পয়সা করে ধরলেও ১২ লাখ টন মত্স্যখাদ্যের বাজারমূল্য ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি হয়। সব ধরনের প্রাণী খাদ্যে প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ভুট্টা, চালের কুঁড়া, সয়া কেক, সরিষার খৈল, গম, সয়াবিন, সয়ামিল, ফিশমিল ও ফিশ অয়েল। এসব খাদ্য উপকরণের বেশির ভাগই আমদানির মাধ্যমে প্রাণী খাদ্য উৎপাদন করতে হয়।
কাজী ফার্মস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান বলেন, মুরগির বাচ্চা, ডিম, মাংস, ফিডসহ এ-সংক্রান্ত প্রায় সব উপকরণই আগে আমদানি করতে হতো। এগুলো এখন দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে সাশ্রয় হচ্ছে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা। তবে পোলট্রি ফিডে ব্যবহূত অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল যেমন— ভুট্টা, সয়াবিন মিল, ভেজিটেবল প্রোটিন প্রভৃতির সিংহভাগ এখনো আমদানিনির্ভর। এগুলোয় উচ্চ করারোপ ও শুল্ক থাকার কারণে প্রাণী খাদ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। প্রাণী খাদ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে ডিম, একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা ও ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে উৎপাদন খরচ বাড়লে মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষের মাঝে ডিম ও মুরগির মাংস কেনার পরিমাণ কমে যাবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুষ্টিনিরাপত্তায়। তাই ভবিষ্যতের খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণীজ আমিষের অন্যতম এ খাতটিকে সম্প্রসারণের সুযোগ দিতে হবে। এজন্য থাকা চাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
প্রাণী খাদ্যের প্রাকৃতিক উত্স কমে যাওয়ার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রস্তুতকৃত খাদ্য মাছ ও মুরগি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে প্রাণী খাদ্যের বাজারের সিংহভাগই কয়েকটি কোম্পানির দখলে থাকায় দাম ও মান নিয়ন্ত্রণের আভিযোগ রয়েছে। খাদ্য তৈরিতে ফাঙ্গাসযুক্ত ভুট্টা ব্যবহার এবং ক্ষতিকর ট্যানারির বর্জ্য ও চামড়া দিয়ে প্রাণী খাদ্য উৎপাদনের অভিযোগও উঠেছে বিভিন্ন সময়। যদিও সম্প্রতি আদালতের মাধ্যমে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
আবার মত্স্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০-এর আওতায় কার্যকর কোনো কর্তৃপক্ষ না থাকায় প্রাণী খাদ্যপণ্যের বাজার তদারকি করাও সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ খাতের মান নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছে মত্স্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র।
এ বিষয়ে ডিএলএসের মহাপরিচালক ডা. মো. আইনুল হক বলেন, আমরা ফিড কোম্পানিগুলোকে কারিগরি সুবিধাসহ বিভিন্ন রকম নীতিসহায়তা দিয়ে আসছি। আইন ও বিধি মোতাবেক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাণী খাদ্য উৎপাদন করছে কিনা, সেটিও তদারকি করা হচ্ছে। এজন্য প্রতিনিয়ত কোম্পানিগুলোতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ পরিদর্শন করা হচ্ছে। সামনের দিনে প্রাণী খাদ্যের চাহিদা আরো বৃদ্ধি পাবে। তাই খাদ্যের মান যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/এম ইসলাম