কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ নাটোর চলতি মৌসুমে নাটোরে প্রায় ১৫ হাজার টন এ্যালোভেরা বা ঘৃত কুমারী উৎপাদন হয়েছে। দেশের একমাত্র ওষুধী গ্রাম খ্যাত লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়ার প্রায় এক হাজার কৃষক শরবত বা জুস, ওষুধ এবং প্রসাধনীর এই উপাদান উৎপাদন করছেন। উৎপাদক থেকে ক্রেতার মাঝে সিন্ডিকেটের অবস্থান থাকায় কৃষকরা এ্যালোভেরার ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে কৃষি বিভাগ ও প্রশাসন কৃষকদের স্বার্থে কার্যকরী ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন।
১৯৯৫ সালের দিকে এলাকার আফাজ পাগলা তার কবিরাজে কাজে ব্যবহারের জন্য নিজ উদ্যোগে ভেষজ উদ্ভিদের চাষাবাদ শুরু করেন। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে পুরোগ্রাম। শেষে সারা ইউনিয়ন জুড়ে। শুধু আবাদি জমিও নয়, গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আনাচে-কানাচে, বেড়া ও রাস্তার ধারে চোখে পড়ে ভেষজ উদ্ভিদের কাজ। তবে সব সৌন্দর্য ছাড়িয়ে এ্যালোভেরা গাছ সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন। নাটোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসের হিসাবে লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়াতে ১৪০ প্রকার ভেষজ উদ্ভিদ জন্মে। এর মধ্যে এ্যালোভেরা ছাড়াও শিমুল মূল, অশ্বগন্ধা, মিশ্রি দানা ও শতমূল প্রসিদ্ধ। ভেষজ উদ্ভিদের ১৪০ হেক্টর মোট আবাদি জমির মধ্যে ৬৫ হেক্টরে ঘৃত কুমারী বা এ্যালোভেরা চাষ হয়েছে।
ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ১ বিঘা জমিতে এ্যালোভেরার ১২ হাজার চারা রোপন করা যায়। সেচের ব্যবস্থা দেখে সারিবদ্ধ এসব গাছ থেকে রোপনের ৩ মাস পর থেকে পাতা সংগ্রহ শুরু হয়। চাষাবাদ, পরিচর্যা ও সেচের কাজে সারা বছর জমিতে ১০০ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। জৈব সার ছাড়াও পরিমাণমত ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, দস্তা ও বোরিক এসিড প্রয়োজন হয়। পাতার কালো দাগ পড়া রোধে ব্যবহার হয় চুন। পাতা ছিদ্রকারী মশাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ দমনে সম্প্রতি ছত্রাক নাশক টাইকোডার্মা ও সেক্স ফেরোমেন ব্যবহারে সম্প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে কৃষি বিভাগ ও কৃষকরা। লক্ষ টাকা খরচ করে বছরে ১ বিঘা জমি থেকে খরচ বাদে লক্ষাধিক টাকার মুনাফা অর্জন সম্ভব। বিঘাপ্রতি এ্যালোভেরার গড় উৎপাদন ৩০ টন। ভেষজ উদ্ভিদ শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে নানা রকম ভেষজ ওষুধ। এর বিপণন কাজ চলছে এলাকার ৪টি স্থানে গড়ে ওঠা প্রায় ৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের
মাধ্যমে। তবে এ্যালোভেরা প্রক্রিয়াজাতকরণের কোন উপায় এলাকাতে নেই। পাতা সংগ্রহ করে দ্রুতই পাঠাতে হয় গন্তব্য। আর এ গন্তব্য ওষুধ ও প্রসাধন শিল্পে, জুস তৈরিতে এবং শরবতে। হামদর্দ ও ২/১টি ওষুধ কোম্পানী এ্যালোভেরার পাতা ক্রয় করে থাকে। ময়মনসিংহের ভালুকাতে স্থাপিত রপ্তানিমুখী জুস তৈরি কারক বিদেশী মালিকানাধীন তাইওয়ান সিন লিন এন্টারপ্রাইজ এ্যালোভেরার বড় ক্রেতা। এছাড়া প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ট্রাক বোঝাই এ্যালোভেরা যাচ্ছে।
এ্যালোভেরার পাতা সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় নিরুপায় উৎপাদনকারী কৃষক থেকে ক্রেতা পর্যন্ত বিপণন কাজে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। কাঁঠালবাড়ীয়া এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২৫ কেজির এ্যালোভেরা বাসকেট তাইওয়ান কোম্পানীর লোকজনের বিক্রি করি ৬০ টাকায়। আর শরবতের বাজারের জন্য ৩০০ কেজির প্যাকেটের বিক্রয় মূল্য ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ কৃষকরা কেজি প্রতি আড়াই থেকে সাড়ে ৩ টাকা দরে এ্যালোভেরা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান তথ্যে দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা।
লক্ষ্মীপুর-খোলাবাড়িয়া ভেষজ উৎপাদন ও বিপণন সমবায় সমিতির সদস্যদের জন্য সমবায় বিভাগ কিছুদিন আগে ভ্রাম্যমান প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছিল। এলাকার কৃষকদের সাথে মত বিনিময়ের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে এসেছিলেন কৃষি সচিব। সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল কাদের প্রামাণিকসহ এলাকার কৃষকরা সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়ত্বের কথা জানান।
তাইওয়ান সিন লিন এন্টারপ্রাইজের একজন ক্রয় প্রতিনিধি এলাকাতে অবস্থানের কথা থাকলেও তার হদিস পাওয়া যায়নি। কৃষকদের উপেক্ষা করে ৪ জনের সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ক্রয় প্রতিনিধি এ্যালোভেরা ক্রয় করেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ঢাকা সহ অন্যান্য স্থানে আড়তের মাধ্যমে এ্যালোভেরা পাঠাতেও সিন্ডিকেট কাজ করছে। তবে কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয়কৃত এ্যালোভেরা ঢাকার ৫০টি স্থানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালনকারী কমিটির উপদেষ্টা উপাধ্যক্ষ আলতাফ হোসেন জানান, আমরা ঢাকার বাজারের চাহিদার সাথে স্থানীয় সরবরাহের সমন্বয় করে থাকি মাত্র।
অর্জুনপুর এলাকায় ৫বিঘা জমিতে এ্যালোভেরা চাষ কারী আদর্শ কৃষক আলফাজুল আলম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এ্যালোভেরার মূল্য হ্রাস কারসাজির অভিনব প্রতিবাদ করেছেন। তিনি এ্যালোভেরার কয়েক মণ পাতা অল্প দরে বিক্রি না করে জমির পাশের গর্তে রেখে জৈব সার তৈরি করছেন। আলফাজুল আলম বলেন, সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে প্রশাসনিক কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। এছাড়া প্রাণ কোম্পানীসহ অন্যান্য জুস তৈরি কারী কোম্পানী ও প্রসাধন সামগ্রীর তৈরি কারী কোম্পানী স্থানীয় বাজার থেকে এ্যালোভেরা ক্রয় করার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরির মাধ্যমে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ হতে পারে।
নাটোর সদর উপজেলা কৃষি অফিসার ড. সাইফুল আলম কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে ওষুধি গ্রামে খুব দ্রুততার সাথে সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনা সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন ভেষজ গ্রামকে নাটোরের ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করে কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে সব রকমের প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকার প্রদান করেছেন।
সুত্রঃ বাসস/ কৃপ্র/এম ইসলাম