কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ হাওড়বাসীর জীবনে একসঙ্গে এত দুর্যোগ আগে কখনো আসেনি। আগে ফসল গেলেও পানি আর মাছের কোনো সমস্যা হয়নি। এবার ধান গেছে, মাছ গেছে, হাঁসও মারা যাচ্ছে। রয়েছে সুপেয় পানির সংকট। হাওড়ের পানি নষ্ট হওয়ায় তা ব্যবহারের উপায় নেই।’ কথাগুলো বলছিলেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ভাণ্ডাবিল হাওড়ের ৭০ বছর বয়সী কৃষক শৈলেন তালুকদার।
ধান, মাছ ও পানি এ তিনটিকে সুনামগঞ্জের সম্পদ বলা হলেও এবার স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্যোগে এর সবই গেছে। প্রথমে অকাল বন্যায় নষ্ট হয়েছে বোরো ধান। এর পর ধান পচে বিষক্রিয়ায় মারা গেছে হাওড়ের মাছ। সেই সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে হাওড়ের পানি। দুর্গন্ধযুক্ত এ পানি ব্যবহারে দেখা দিচ্ছে চর্মরোগ। এরই মাঝে অনেক হাওড় এলাকায় খামারিদের হাঁসও মারা যাচ্ছে। ফলে সর্বস্ব হারিয়ে এখন দিশেহারা হাওড় পাড়ের মানুষ।
প্রবীণরা জানিয়েছেন, তারা তাদের জীবত্কালে এমন দুর্যোগ আগে কখনো দেখেননি। শৈলেন তালুকদারের মতো একই কথা জানান বিশ্বম্ভরপুর এলাকার কৃষক আজমান আলীও। তিনি বলেন, প্রায় বছরই পানিতে ধান তলিয়ে যায়। কিন্তু মাছ মরে যাওয়া ও পানিতে এমন দুর্গন্ধ কখনই হয়নি। হাওড় বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব বিন্দু তালুকদার বলেন, হাওড়ে একসঙ্গে ধান, মাছ ও পানি নষ্ট হওয়ার নজির নেই।
এদিকে গতকাল হাওড়ের পানি দূষিত হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে সুনামগঞ্জ আসে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট নদী কেন্দ্র চাঁদপুরের তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। তারা দিনভর তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর এলাকার বিভিন্ন হাওড়ের পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলি পরীক্ষা করেন। প্রতিনিধি দলের প্রধান ও মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাসুদ হোসেন বলেন, হাওড়ের পানি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। পানিতে গ্যাসের উপস্থিতি রয়েছে ও অক্সিজেন কমে গেছে। এ পানি মাছসহ যেকোনো প্রাণীর জন্যই ক্ষতিকর। যা প্রাণহানির কারণ হতে পারে।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি অনুষদের প্রধান মাহবুব-ই এলাহী বলেন, অ্যামোনিয়া গ্যাসের প্রভাবে হাওড়ে মাছ ও হাঁস মারা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন এ অবস্থা থাকলে হাওড় অঞ্চলের মত্স্য-পশুসম্পদ তথা জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। প্রজনন মৌসুমে মাছ বিষাক্রান্ত হওয়ায় মাছের ঘাটতি দেখা দেবে।তবে হাওড়ের পানিদূষণ ও মাছ-হাঁসের মৃত্যুর জন্য সিলেট সীমান্তের ওপারে ভারতে অপরিকল্পিতভাবে ইউরেনিয়ামসহ খনিজ সম্পদ আহরণকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম। তিনি বলেন, ভারত মেঘালয়ের পাহাড়ে অপরিকল্পিতভাবে ইউরেনিয়াম উত্তোলন করছে। এতে ওই এলাকার পরিবেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে মাছ ও পশু।
পাহাড়ি ঢলে মেঘালয় থেকে সুরমা, সারি, কংশ ও যাদুকাটা নদীতে পানি আসে, যা বাঁধ ভেঙে হাওড়ে প্রবেশ করে। ইউরেনিয়াম মিশ্রিত পানি আসার কারণেই হাওড়ে মাছ ও হাঁস মরছে। পানি দূষিত হচ্ছে। তাই এখানকার মাটি ও পানি পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, হাওড়ের মাছ খেয়ে সহস্রাধিক হাঁস মারা গেছে। এসব হাঁসের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
জেলা মত্স্য কর্মকর্তা শঙ্কর রঞ্জন দাস বলেন, ধান পচে পানিতে অক্সিজেন একেবারে কমে গেছে। অন্যদিকে অ্যামোনিয়া গ্যাস বেড়ে গেছে স্বাভাবিকের চেয়ে বহু গুণ। এ কারণে হাওড়ের মাছ মরে ভেসে উঠছে। মাছের মড়ক ঠেকাতে আমরা চুন ও জিওলাইট ব্যবহার করছি। এতে মাছও রক্ষা পাবে, পানিদূষণও রোধ হবে। আর টানা বৃষ্টি হলে এ সমস্যা কেটে যাবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক ডা. ইসলাম ফারুক বলেন, হাওড়ের দূষিত পানিতে গোসল, রান্না ও খাবার কাজে ব্যবহার না করতে এলাকাবাসীকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
আর সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রশাসন মাইকিং করে হাওড়ের পচা মাছ না খাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। তাছাড়া এসব জলাশয়ে সব ধরনের মাছ ধরা এক সপ্তাহের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ দুর্যোগ মোকাবেলায় ৬৬০ টন চাল, ২৬ লাখ টাকা এবং প্রতি উপজেলায় তিন টন করে ওএমএসের চাল ও আটা বিক্রি করা হচ্ছে।
কৃপ্র/এম ইসলাম