‘নার্সারি কন্যা নূরজাহানের ভাগ্য বদলের গল্প’
এ কিউ রাসেল: নূরজাহান বেগম। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কোন এক বর্ষণের দিনে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চরনিকলা গ্রামে জন্ম নূরজাহান বেগমের। চার ভাই তিন বোনের সংসারে তার অবস্থান পাঁচ। জন্মের সময় পরিবারের আর কেউ তেমন ভাবে খুশি হতে না পারলেও তার বাবা অনেক খুশি হয়েছিলেন। জন্মের পরপরই বাবা ঘোষণা দিয়েছিলেন তার এ মেয়েটিকে এমএ পাশ করাবেন।
নূরজাহান বেগম এমএ পাশ ঠিকই করেছেন কিন্তু তার দৃশ্যটা, সব থেকে ভালোবাসার মানুষটি তা দেখে যেতে পারেননি। তিনি যখন ৭ম শ্রেণীতে পড়েন তখন তার বাবা মমতাজ আলী শেখ মারা যান। বাবা মারা যাবার পর কিছুটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো তাদের পরিবার। সপ্তম শ্রেণিতেই হয়ত থেমে যেত তার লেখা-পড়া। কিন্তু মা হালিমা বেওয়ার দৃঢ়চেতা মনোভাবে সব ঠিক হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৮৬ সালে ইবরাহীম খাঁ সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও একই কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালে বিএ পাশ করেন।
এরপর তার জীবনে বয়ে যায় ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের এক ঝড়। সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। থমকে যায় প্রতিদিনের জীবনের গতি। কিন্তু যোদ্ধা মানুষ কি যুদ্ধ না করেই সমাজ জীবনের কাছে হারতে পারেন? না, তিনিও ঝড়ের অস্বাভাবিকতা কাটিয়ে উঠার জন্য ২০০০ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বরে যোগদেন ব্রাকের মাইক্রো ফিন্যান্স প্রোগ্রামে। সেখানে থেকে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে যোগ দেন ব্র্যাকের আরেকটি প্রোগ্রামে। মূলত এই প্রোগ্রামে কাজ করতে করতেই পাল্টে যেতে থাকে জীবনের গতি। নিবিড় ভাবে শিখতে থাকেন তার ভালোবাসার কাজটি।
কৃষির প্রতি ভালোবাসা আর চাকরিতে মোটরসাইকেল চালনায় শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে খুঁজে পান ফিরে আসার পথ। পরিবারের শত বাঁধা উপেক্ষা করে ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারির এক পিকআপ ভ্যান চায়না-৩ জাতের লিচু কলমের চারা নিয়ে হাজির হন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চরনিকলা গ্রামের নিজ বাড়িতে। শুরু করেন নতুন জীবন। বাবার দেয়া ২০ শতক জমি আর নগদ ১লাখ টাকা দিয়ে গড়ে তুললেনে ‘তোয়া’ নামের এক নার্সারি। বাড়ির সকলেই বিরোধীতা করলেও ময়মিনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া ছোট ভাই ফরিদ সাহস যুগিয়ে দিয়েছেন নানাভাবে।
শুরুতেই সফলতা পাননি নার্সারি কন্যা নূরজাহান বেগম। প্রথম বছর লিচু কলমের চারা ব্যাতিত আর সবই ছিল বনজ গাছের চারা। চারা বিক্রির সময় হলে তিনি দেখলেন বনজ গাছের চারায় যত টাকা ব্যায় করেছিলেন সবই লোকসান। কারণ হিসাবে তিনি বললেন, মানুষ যে ধরনের গাছের চারা চায় তিনি সেই ধরনের চারা তাঁর নার্সারিতে ঠাই দেননি। মানুষের চাহিদা ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি গাছের চারা আর তিনি করেছেন নিম থেকে শুরু করে দেশীয় জাতের বনজ চারা। পাড়া-প্রতিবেশিদের টাকা ছাড়া চারা দিতে চেয়েও দিতে পারেননি। সবাই এক বাক্যে বলেছেন কি হবে এই চারা দিয়ে?
এক দিকে ৩০ হাজার টাকা লোকসান আর অন্যদিকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিদেশী কোন জাতের চারা না করার অঙ্গীকার। বড়ই টালমাটাল অবস্থা। কি করবেন জানা নেই। আবার হেরে যেতেও তার বড় লজ্জা। নীতির কাছে আপসহীন নারীর আপস কোন ভাবেই হতে পারেনা। তিনিও আপস করেননি, লেগে গেলেন নতুন করে। এবার আর তাড়াহুড়া করে নয় জেনে বুঝে। আবারো ছোট ভাই ফরিদ এগিয়ে এলেন। সেই সময় টিভি-পত্রিকায় টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাহাড়ি জনপদ গারো বাজারে বসবাসরত আজিজ কোম্পানীর অনেক নামডাক। ছোট ভাই ফরিদ জানালেন, চাষা আজিজের সব কৃতির কথা। বললেন, তুমি যেহেতু ফলের গাছেরই নার্সারি করবে তাই ওনার কাছ থেকে ঘুরে আস। এক বৃষ্টি-বাদলার দিনে অনেক কষ্ট করে পৌছে গেলেন চাষা আজিজের বাড়িতে।
এর পরেরটুকু জানালেন চাষা আজিজ, বললেন বৃষ্টির দিনে পাহাড়ি রাস্তা কাঁদায় কোমড় পর্যন্ত দেবে যায়। তেমনি ৫ কি. মি. রাস্তা পেরিয়ে নূরজাহান যখন আমার বাড়িতে উপস্থিত হয় তখন তাকে দেখে চেনার উপায় নেই সে মানুষ না মহিষ! তার সব কিছু জানার পর আমার অনুভুতি, ১ হাজার জন পুরুষ মানুষে যা না পারবে এই মেয়ে একাই তাই করে দেখাবে।
জহুরি চিনতে ভুল করেননি চাষা আজিজ। চাষা আজিজের পরামর্শ ও সহযোগিতায় অনেক দূর এগিয়ে গেছেন নূরজাহান বেগম। জেলা পর্যায়ে চার বার সেরা নার্সারির পুরস্কার পেয়েছেন। সার্বক্ষণিক ২ জন কর্মচারী আর ৬ হাজার বিভিন্ন জাতের ফলজ গাছের চারায় ভরপুর তার নার্সারি। ১ লাখ টাকা মূলধনের নার্সারি নিষ্ঠা আর সাধানায় ফুলে ফেপে হয়েছে ১০ গুণ।
এতো কিছুর পরেও আর বিয়ে করেননি নার্সারী কন্যা নূরজাহান বেগম। করতেও চান না। তার ভাষায়, ‘রক্তের সাথে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া এই নার্সারিই আমার পরিবার, আর সমস্ত ফলদ গাছের চারা আমার সন্তান।’
লেখক :সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, টাঙ্গাইল।