কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন সুনামগঞ্জের বিশ্বম্বরপুর উপজেলার পদ্মনগর গ্রামের স্বপ্না বেগম (৩৮)। ঋণের টাকায় মাছ ধরার নৌকা মেরামত করার পাশাপাশি জাল কিনেছিলেন তিনি। এ নৌকা দিয়ে মাছ ধরে ও কৃষি শ্রমিকের কাজ করে তার স্বামী যা উপার্জন করতেন, তা দিয়ে কোনো রকমে চলত স্বপ্নার ছয় সদস্যের পরিবার। কিন্তু হাওড়ে এবার আগাম বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ায় দিনমজুরের কাজ নেই। মাছ ধরাও বন্ধ। এখন খাবার জোটে না স্বপ্নার পরিবারে। শোধ দিতে পারেননি ঋণের কিস্তিও। স্বপ্না বলেন, ‘ভাত জোটে না, কিস্তি দিব কীভাবে। ঋণ মনে হয় শোধ করতে পারব না। অফিসার আসছিল। বলে দিয়েছি, কাজ না পাওয়া পর্যন্ত কিস্তির টাকা দিতে পারব না। ঋণ শোধ দিতে না পারলে কী হবে, তা নিয়ে ভয়ে আছি।’ প্রতিবেদন বনিক বার্তা।
বাহারকান্তি হাওড়ে নিজের ও বর্গা মোট ১৫০ শতক জমিতে বোরো ধান বুনেছিলেন কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার ফাইজুদ্দিন মিয়া (৬০)। গত রোববার স্ত্রী, দুই ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে সপরিবারে রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে গ্রাম ছেড়েছেন তিনি। প্রতিবেশী রিকশাচালক কামাল উদ্দিন বলেন, ফসল ফলাতে আর পরিবারের খরচের জন্য এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে লাখ টাকার বেশি ঋণ করেছিলেন ফাইজুদ্দিন। গরু বিক্রি করে ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। বাকি টাকার জন্য পাওনাদাররা তাগাদা দিত। ঢাকা যাওয়ার সময় বলে গেছেন, টাকা জোগাড় করতে পারলে বাড়ি ফিরবে, আর না হলে ফিরবে না।
কামাল উদ্দিন বলেন, ‘কাজের সন্ধানে শত শত লোক ঢাকা ও চট্টগ্রামের দিকে গেছে। গ্রাম ছেড়ে পরিবারসহ গেছে কেউ কেউ। আরো অনেকেই যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজেও ব্র্যাক, আশা ও মহাজনের টাকা নিয়েছি, পরিশোধ করার কোনো পথ তো নাই। কিস্তি দিতে না পারলে রিকশাটা বিক্রি করতে হবে। তখন ছেলেমেয়ে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। ঋণ নিয়ে সবসময় একটা আতঙ্ক ভর করছে মনে।’
স্বপ্না বেগম, ফয়জুদ্দিন ও কামাল উদ্দিনের মতো হাওড়াঞ্চলের (হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ) অধিকাংশ মানুষই ঋণগ্রস্ত। বিভিন্ন এনজিও ও মহাজন ছাড়াও ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছেন কেউ কেউ। কৃষকদের মতোই ঋণগ্রস্ত হাওড়াঞ্চলের সহস্রাধিক চালকল মালিকও। বর্তমান পরিস্থিতিতে খেলাপি হতে হবে— এ ভয়ে বন্ধক রাখা জমি, যন্ত্রপাতি ও বসতবাড়ি হারানোর আতঙ্কে আছেন মিল মালিকরাও।
নেত্রকোনা জেলায় চালকল আছে মোট ২৪৪টি। অধিকাংশই চালকলের মালিকই ঋণ নিয়ে ব্যাংকে জমি ও বাড়ি বন্ধক রেখেছেন। ঋণখেলাপি হওয়ার আতঙ্কে আছেন, এমন এক চালকল মালিক নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার তমাল অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী মাসুদ মিয়া। তিনি বলেন, ‘জনতা ব্যাংকের মোহনগঞ্জ শাখা থেকে মিল ও জমি বন্ধক রেখে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। গত বছর প্রচুর ধান এসেছিল মিলে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এ বছর গত তিনদিনে এসেছে ৫০০ মণ ধান। কিস্তি পরিশোধ করতে না পারলে খেলাপি হয়ে যাব। তখন আমার মিলসহ বসতভিটা নিলামে উঠাবে ব্যাংক।’
সুনামগঞ্জ জেলায় চালকল আছে ২৬৫টি। সালনা উপজেলার চালকল মালিক জুবায়ের আহমেদ উচ্চসুদে ঋণ নিয়েছেন এনজিও ও স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে। তিনি বলেন, ‘এনজিও ও এলাকার লোকের কাছে ঋণ নিয়েছি। এখন মিলে কোনো কাজ নেই। আশপাশের জেলাগুলোতেও একই অবস্থা। বাইরে থেকে ধান আনারও সুযোগ নেই। ধান থাকলে ঋণ থাকত না। এখন কী হবে বুঝতে পারছি না।’
তাড়াইলের ডিঙ্গাউতা হাওড়ে অনেকের মতো ডুবে গেছে কৃষক মো. আবু তাহেরের ৪০০ শতক জমির বোরো ধান। ধান বুনতে ধারদেনার পাশাপাশি তিনি কৃষি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা। ফসল ডুবে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না এ কৃষক। তিনি বলেন, দুই কিস্তি দিয়েছি, এখন টাকা নাই কীভাবে দিব? মাছ ধরাও নিষেধ। খাবই বা কি!
সরকার ঋণের কিস্তি আদায়ে এনজিওগুলোকে নমনীয় হওয়ার নির্দেশ দিলেও তা মানছে না অনেকেই। হাওড় এলাকায় নিয়মিত কিস্তি তুলছে গ্রামীণ ব্যাংক ও আশাসহ সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলো। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই কিস্তি না তুলে খালি হাতেই ফিরতে হচ্ছে মাঠপর্যায়ের এনজিও কর্মকর্তাদের।
ক্ষদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান আশার জোনাল ম্যানেজার (সিলেট বিভাগ) সাজেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঋণের টাকা তুলতে জোরজারি না করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ নতুন করে ঋণ চাইলে, তাও দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তবে মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানে এমন নির্দেশের প্রতিফলন দেখা যায়নি। রিকশাচালক কামাল উদ্দিন বলেন, বৃহস্পতিবার কিস্তি নিতে আসেন আশার কর্মকর্তারা। গত সপ্তাহে কিস্তি দিতে পারি নাই। তারা বলে গেছেন, আগামী বৃহস্পতিবার দুই কিস্তির টাকা একসঙ্গে পরিশোধ করতে হবে।
কৃপ্র/এম ইসলাম