কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ রংপুর অঞ্চলে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত ধানি জমির পরিমাণ বেড়েই চলছে। কীটনাশক ব্যবহার করেও রক্ষা করা যাচ্ছে না ধানগাছ। এতে ফলন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। এদিকে মাত্র ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখলেও ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে অধিকাংশ জমির ধানগাছ এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে।
কৃষি অফিস রংপুর অঞ্চলে গত রোববার পর্যন্ত ব্লাস্ট আক্রান্ত জমির পরিমাণ ৪৩ দশমিক ৫ হেক্টর উল্লেখ করলেও বাস্তবে এর পরিমাণ আরো অনেক বেশি বলে দাবি করেছেন কৃষকরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রংপুর সদর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারীর অধিকাংশ কৃষক চলতি মৌসুমে বোরো ধানের জমি ব্লাস্ট রোগ থেকে বাঁচাতে বিভিন্ন কোম্পানির কীটনাশক ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি আক্রান্ত হয়নি এমন জমির মালিকও ফলন রক্ষা করতে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে কীটনাশক প্রয়োগসহ পরিচর্যা করছেন।
রংপুর সদর উপজেলার ৩ নম্বর চন্দনপাঠ ইউনিয়ন ঈশ্বরপুর মাঠের হাটগ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় দুই বিঘা (৩৩ শতকে এক বিঘা) ব্রি-২৮ জাতের ধানের জমি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ধানগাছের যে জায়গা থেকে শিষ শুরু হয়, সেখান থেকে শিষটি সম্পূর্ণ সাদা হয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে। আর মাত্র ১০ দিনের মধ্যে ফলন ঘরে তোলার কথা ছিল। কিন্তু ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে তা আর হলো না।
তিনি বলেন, ‘রোগাক্রান্ত না হলে প্রতি বিঘায় ২০-২৫ মণ ধান পাওয়া যেত। এখন দুই-পাঁচ মণ ধান পাওয়া নিয়েও সংশয় রয়েছে। প্রতি বিঘায় এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৯ হাজার টাকা। উত্পাদিত ধান বিক্রি করে লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছি না।’একই গ্রামের কৃষক কামরুজ্জামান বকুল বলেন, ‘আমার জমির ফসলও ব্লাস্ট রোগের আক্রান্ত হয়েছে। দোকানদারদের পরামর্শে একাধিক কোম্পানির কীটনাশক ব্যবহার করেও রোগের প্রকোপ কমাতে পারিনি।’
কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর মাঠের পাড়গ্রামের কৃষক আব্দুল বাতেন বলেন, ‘আমার ১৪ বিঘা জমির মধ্যে প্রায় তিন বিঘা জমির ধান ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে কৃষি অফিসের পরামর্শে ছত্রাকনাশক ওষুধ ব্যবহার করছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কাজ হচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘গত বছর প্রতি বিঘায় প্রায় ৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল, কিন্তু এ বছর ধানের জমি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় এরই মধ্যে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। একদিকে উত্পাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে রোগাক্রান্ত ধানের জমি থেকে শতকরা ২০ ভাগ ধান পাব কিনা সন্দেহ আছে। তাই এ বছর লোকসান ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।’
স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ আক্রান্ত জমির বীজ কৃষকরা বিএডিসি ও নিজস্ব উত্স থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। অনেকে বলছেন, বীজে ত্রুটি থাকার কারণে হয়তো এসব ধানে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ বেশি হয়েছে। রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলে ব্লাস্ট আক্রান্ত জমির পরিমাণ হচ্ছে ৪৩ দশমিক ৫ হেক্টর। এর মধ্যে রংপুর জেলায় ১২, গাইবান্ধায় ৫ দশমিক ৫, কুড়িগ্রামে ৬ দশমিক ৭, লালমনিরহাটে ৭ দশমিক ৮ ও নীলফামারীতে ১১ দশমিক ৫ হেক্টর জমি ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। প্রতিটি জেলায় আক্রান্ত জাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্রি-২৮। তবে লালমনিরহাটে ব্রি-২৮-এর পাশপাশি ২৯, ৩১ ও ৬৩ জাতের ধানের জমিও ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট গাজীপুরের পরিচালক (গবেষণা) ড. মো. আনছার আলী বলেন, ‘নেক ব্লাস্ট হচ্ছে একটি ছত্রাকজনিত রোগ। ধানের শিষের গোড়ায় রোগটি পরিলক্ষিত হয়। বাদামি অথবা কালো দাগ পড়ে। আক্রান্ত শিষের গোড়া পচে যায় এবং ভেঙে পড়ে। শিষের গোড়া ছাড়া যেকোনো শাখা আক্রান্ত হতে পারে। ধান পুষ্ট হওয়ার আগে আক্রান্ত হলে শিষের ধান চিটা হয়ে যায়। এ রোগের প্রাদুর্ভাব প্রধানত আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। দিনের বেলায় গরম এবং রাতে ঠাণ্ডা, ঘন কুয়াশা দীর্ঘ শিশিরভেজা সকাল, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে এ রোগের বিস্তার হয়।’
তিনি বলেন, যেসব জমির ধান নেক ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়নি অথচ ওই এলাকায় ব্লাস্ট রোগের অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করছে অথবা এরই মধ্যে কিছু স্পর্শকাতর আগাম জাতে এ রোগের আক্রমণ লক্ষ করা গেছে। সেখানে ধানের থোড় অবস্থায় শেষ পর্যায়ে একবার এবং ধানের শিষ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার ছত্রাকনাশক যেমন ট্রপার (৫৪ গ্রাম/বিঘা) অথবা নেটিভো (৩৩ গ্রাম/বিঘা) শেষ বিকালে নির্ধারিত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম