ড. মো. হুমায়ুন কবীর: সময় যাচ্ছে আর আবহাওয়া, জলবায়ু, পরিবেশ ইত্যাদি দিনকে দিন বিরূপ আচরণ করছে। এর সর্বশেষ নজির হলো সাম্প্রতিক হাওরাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ বিপর্যয় যে শুধু এখন হাওরেই সীমাবদ্ধ তা কিন্তু নয়। এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশময়। মাসাধিককাল ধরে প্রায় প্রতিদিনই গণমাধ্যমে খবর আসছে সারাদেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা। কিন্তু এখন যে সময়ে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবরগুলোর আসছে সেগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন নয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে এর সময় ও তীব্রতা নিয়ে।
আমরা জানি গত ২৯ মার্চ ২০১৭ তারিখ থেকে হাওরাঞ্চলে যে উজানের পাহাড়ি ঢল শুরু হয়েছিল। তার তীব্রতায় মাসাবধি আগাম বন্যায় ফসল, মাছ, হাঁস, ব্যাঙ, গবাদিপশুসহ অন্যান্য প্রাণীকুলের যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা আমরা সকলেই বিগত কিছুদিনে উপলব্ধি করতে পারছি। অপরদিকে সারাদেশজুড়েই শুরু হয়েছে এবারে আগাম অতিবৃষ্টিজনিত বন্যা। সেইসাথে বজ্রপাত ও কালবৈশাখী কিংবা টর্নেডো তো রয়েছেই। দেশের বিভিন্ন নি¤œাঞ্চল পানির নিচে চলে যাওয়ায় সেসব স্থানে বর্তমানে মাঠে থাকা বোরো ধানসহ অন্যান্য সকল ধরনের কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের ধান আবাদের প্রায় ৮০ শতাংশ জুড়ে থাকা বোরো ধানের যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনভাবেই পূরণযোগ্য নয়। এখন কথা উঠেছে যে এবারের বোরো আবাদের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে কিনা। কারণ সারাদেশে প্রায় বোরোতে ৪৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদের মাধ্যমে প্রায় দুই কোটি মেট্রিক টন ধান ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিণ করা হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে হাওরাঞ্চলে প্রায় দুই লক্ষাধিক হেক্টর জমির বোরো ধানের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগই বিনষ্ট হয়েছে। সেখানে প্রায় ৫ লক্ষাধিক মেট্রিক টন ধান এবং সেই পরিমাণ টাকার অংকে দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের উত্তরবঙ্গে চলনবিলসহ অন্যান্য নি¤œাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল, পূর্বাঞ্চলসহ সারাদেশেই আরো প্রায় সমপরিমাণ বোরো ধানের ক্ষতির খবরও গণমাধ্যমে হর হামেশাতেই প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তাছাড়া এসময়ে কৃষি ফসলের মধ্যে কাঁচা মরিচ, বেগুন, কুমড়া, করলা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ঢেড়শ, শসা, বরবটি ইত্যাদি সবজি ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি করেছে এ আগাম বৃষ্টিজনিত বন্যা ও ঝড়-ঝঞ্ঝা। সামনে আসন্ন রমজান মাসে এসব ফসলের কম উৎপাদনের কারণে তাদের দামের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে রমজানের নিত্যপণ্য হিসেবে দাম বাড়তে পারে কাঁচা মরিচ, শসা, বেগুন ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সবজি ফসলের দামের উপর। ইতোমধ্যে সব ধরনের ধান এবং চালের মূলের উপর এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রকারান্তরে এগুলো জনস্বার্থ পরিপন্থি হতে বাধ্য।
অথচ এগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিবছরই এমনভাবে দেখা যায় না। আমরা যখন পরিবেশ পরিবেশ কিংবা জলবায়ু জলবায়ু করে চিৎকার করি তখন সেটাকে কেউই পাত্তা দিতে চায় না। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবকিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণীই এক্ষেত্রে সত্যি হতে চলেছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন হওয়ায় শীতে শীত থাকছেনা, গরমে গরম থাকছে না, বর্ষাকালে বৃষ্টি থাকছেনা, কখনো অতি গরম আবার কখনো বা অতি শীত আবার বর্ষা শুরু হতে না হতেই উচ্চশব্দে বজ্রপাতে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে, যা আগে কখনোই তেমন দেখা যেতো না। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এখন আসলে তাই হচ্ছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এবারে হাওরাঞ্চলে যে আগাম বন্যায় ক্ষতি হয়ে তা বিগত ১২০ বছরে দেখা যায়নি। অপরদিকে সারাদেশে যে যে বজ্রপাত ও ঝড়-ঝঞ্ঝা বিগত প্রায় তিনদশক দেখা যায়নি। কিন্তু এসব এখন হচ্ছে, তার অন্যতম কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। যদিও দুর্যোগ ঘটে যাওয়ার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ), বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন (বিএনএফ) সহ আরো অনেক সরকারি বেসরকারি সংস্থা তাদের যার যার সাধ্যমতো সেসব হাওরের দুর্গত মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেছে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো হতো যদি পরিবেশ দুষণ কমিয়ে এসব দুর্যোগের হাত থেকে আগেই জানমালের রক্ষা করা যেতো।
বলতে গেলে এসবের সৃষ্টি করছি আমরা নিজেরাই। কারণ ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন আধুনিক জীবন যাপনের উপজাত হিসেবেই সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশ ধ্বংসকারী বিভিন্ন পরিবেশ বিপর্যয়কর বস্তু। পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার, গাছপালা না লাগিয়ে শুধু কর্তন, শোধন না করে শিল্প কারখানার বর্জ্য অপসারণ, বিভিন্নভাবে ক্ষতিকর গ্রিন হাউজ গ্যাস সৃষ্টি, পানির স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ করা, নদ-নদী ভারাট করে ¯্রােতধারা পরিবর্তন, অবৈজ্ঞানিক ইটভাটা স্থাপন ইত্যাদিসহ আরো অনেক কিছু। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপর মানুষের কোন হাত নেই। তবে অভিযোজনের মাধ্যমে তা সংকোচনের চেষ্টা করার সুযোগ রয়েছে। এখন একটি সুন্দর আগামীর জন্য সেদিকেই আমাদের হাঁটতে হবে।
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
কৃপ্র/এম ইসলাম