‘চাল আমদানিতে শুল্ক তুলে দিলে প্রান্তিক কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া অনিশ্চিত’
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ দেশের চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে ও চাল সরবরাহ বাড়ানোর জন্য চাল আমদানিতে সব ধরনের শুল্ক তুলে দেয়ার সুপারিশ করেছে খাদ্য অধিদপ্তর। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে বোরো মৌসুমের শুরুতেই চাল আমদানিতে শুল্ক তুলে দিলে কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া অনিশ্চিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধ ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের পাশাপাশি চালের আমদানি নিরুত্সাহিত করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আমদানি শুল্কহার ১০ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। এর সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) হিসেবে যোগ হয় আরো ৩ শতাংশ শুল্ক। ফলে দেড় বছর ধরে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। এ শুল্ক কমানোর জন্য বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে ব্যবসায়ীরা দাবি জানালেও এতে সাড়া দেননি নীতিনির্ধারকরা।
সম্প্রতি হাওড়াঞ্চলে বন্যা ও সারা দেশেই কমবেশি ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাবে চাল উত্পাদন কমার শঙ্কা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক দিনেই চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এ অবস্থায় আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. কায়কোবাদ হোসেন বলেন, গত কয়েক দিনে চালের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে বাজার স্থিতিশীল রাখতে চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হয়েছে। এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ এনবিআরে পাঠানো হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়লে বাজারে চালের দাম কমবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমরা আশাবাদী।
চলতি বছর পাহাড়ি ঢল ও অকাল ভারি বর্ষণে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ সিলেট বিভাগের হাওড়াঞ্চলে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ঝড় ও নিচু এলাকার ফসলডুবিসহ নানা কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বোরো ফসল ঘরে তোলা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় এনবিআরের কাছে পাঠানো চিঠিতে বাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চাল আমদানিতে আরোপিত শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে উত্তরবঙ্গ ছাড়া দেশের সব অঞ্চলে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় চালের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করলে কম দামে চাল আমদানির দিকেই ব্যবসায়ীরা ঝুঁকতে পারেন। ফলে কৃষকের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ কমে যাবে। এতে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন কৃষক। এছাড়া শুল্কমুক্তভাবে আমদানি করলেই যে ব্যবসায়ীরা চালের দাম কমাবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই। একবার দাম বেড়ে গেলে তা কমানোর রেকর্ড এ দেশে খুবই কম। এ অবস্থায় ভোক্তা ও কৃষককে বাঁচাতে সরকারকে অবশ্যই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সম্মানিত ফেলো ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কৃষকের স্বার্থ রক্ষার জন্য চাল আমদানিতে সম্পূর্ণভাবে শুল্ক তুলে দেয়া মোটেও যৌক্তিক হবে না। শুল্কমুক্তভাবে চাল আমদানি করলেই যে চালের দাম কমবে, এরও তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে ভোক্তাস্বার্থে উত্পাদন পরিস্থিতি আরো সূক্ষ্মভাবে বিবেচনা করে কিছুদিন পর শুল্ক কিছুটা কমিয়ে আমদানির সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য উত্পাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে কৃষকের ভর্তুকি সহায়তা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া অকালবন্যা বা ব্লাস্ট রোগের কারণে যে পরিমাণ ফসলহানি হয়েছে, তাতে বাজারে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি হওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। অধিদপ্তরের হিসাবে, হাওড়াঞ্চলের বন্যায় সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এ ছয় জেলায় এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৪১ হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গেছে, যা এ ছয় জেলার মোট আবাদি জমির প্রায় ৩৮ শতাংশ। এছাড়া উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় নেক ব্লাস্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এসব কারণে প্রায় ছয় লাখ টন ফসলহানি হয়েছে বলে সম্প্রতি এক সেমিনারে জানিয়েছেন স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ফসলহানি হয়েছে, তবে বাজারে এর বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ বছরে ২ কোটি ৯০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ টন চাল উত্পাদন হয় দেশে।
জানা গেছে, গত ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারের গুদামে মোট খাদ্যশস্য মজুদ ছিল ৪ লাখ ৯৮ হাজার টন। এর মধ্যে চাল রয়েছে ৩ লাখ ৫ হাজার টন। আর গম ছিল ১ লাখ ৯৩ হাজার টন। এছাড়া বন্দরে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে আরো ২৫ হাজার টন খাদ্যশস্য। গত বছর এ সময়ে মোট মজুদ ছিল ১০ লাখ ৩১ হাজার টন। এর মধ্যে চাল ৭ লাখ ৩৫ হাজার টন ও গম ২ লাখ ৯৬ হাজার টন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কম হলেও বর্তমানে সরকারের খাদ্য মজুদ যথেষ্ট সন্তোষজনক। হাওড়াঞ্চলের বন্যাদুর্গতদের জন্য এরই মধ্যে ওএমএস চালুসহ সরকার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ অবস্থায় চাল আমদানি শুল্কমুক্ত করতে হলে, তা যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণ করে নেয়া প্রয়োজন, যাতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের স্বার্থই রক্ষা হয়।
এ বিষয়ে সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, আমরা যদি চাল উত্পাদনে উদ্বৃত্ত হয়ে থাকি, তাহলে আমদানির কোনো প্রয়োজন তো নেই। বাজারে চালের ঘাটতি থাকলে কিছুটা শুল্কমুক্ত করে আমদানি বাড়ানো যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে কৃষক ও ভোক্তা উভয় স্বার্থ রক্ষায় কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান বাড়াতে হবে।
সুত্রঃ বনিক বার্তা / কৃপ্র/এম ইসলাম