কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ রফতানি আয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিমায়িত চিংড়ি। বিদেশের বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় এ চিংড়িকে ঘিরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক হ্যাচারি ও ঘের, যেখানে কর্মরত প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা এসব চিংড়ি শ্রমিককে অল্প মজুরির বিনিময়ে অনেক বেশি খাটতে হয়। অনেক সময় অগ্রিম টাকার ফাঁদে ফেলে জোরপূর্বক শ্রম আদায় করা হয় তাদের কাছ থেকে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় বাংলাদেশের চিংড়ি শ্রমিকদের এমন দুঃখ-দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের অর্থায়নে পরিচালিত ‘রিসার্চ অন ইন্ডিকেটর অব ফোর্সড লেবার ইন দ্য সাপ্লাই চেইন অব শ্রিম্প ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, চিংড়ি সংগ্রহ, ঘের ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা প্রতিটি পর্যায়েই স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। সারা দিন কাজ করেও গড়ে ১০০ টাকা আয় করতে পারেন না তারা। ঋণগ্রস্ততা, দালালের মাধ্যমে অগ্রিম অর্থ গ্রহণ, সংসারের অভাব-অনটনসহ বিভিন্ন কারণে এভাবে শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন চিংড়ি শ্রমিকরা।
১২ বছরের শিশু অজিত। অগ্রিম টাকার লোভে এ বয়সের ছেলেকে মাছ ধরার কাজে দিতে দালালের প্রস্তাবে রাজি হন তার বাবা। জীবনের প্রথম অর্থ উপার্জনের কথা ভেবে অজিতেরও আগ্রহের ঘাটতি ছিল না। পরিবারের সঙ্গে চূড়ান্ত কথা শেষে শিশু অজিতকে নিয়ে যাওয়া হয় দুবলারচরে। সেখানে গিয়েই তার চোখে ধরা পড়ে অচেনা এক বাস্তবতা। কর্মজীবনের প্রথম দিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা কাজ করতে হয় তাকে। ওইদিন সারা দিন কাজ শেষে মিলেছে রাতের খাবার। অমানুষিক এ কষ্ট সইতে না পেরে বাড়ি ফিরতে চাইলেও তার কোনো পথ ছিল না অজিতের।
দুর্ঘটনায় স্বামীর ডান হাত হারানোর পর দালালের মাধ্যমে চিংড়ি হ্যাচারিতে কাজ নেন চন্দ্রা। চুক্তিভিত্তিক কাজে দৈনিক আয় ৭০-৮০ টাকা। চন্দ্রা জানান, প্রায়ই ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। কাজের প্রয়োজনে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। চন্দ্রার তিন সন্তানের মধ্যে ছোট মেয়ের বয়স ছয় বছর। বিয়ের বয়স হলেও টাকার অভাবে বড় মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না। নতুন কিছু করার সাহস তো দূরে থাক, নিয়মিত জীবিকা ছেড়ে গেলে না খেয়ে থাকতে হবে, এ ভাবনাই তাড়া করে চন্দ্রাকে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, অল্প মজুরির কারণে পরিবারের ভরণ-পোষণের বাইরে কিছু চিন্তা করার অক্ষমতা, কাজ চলে গেলে নতুন কাজ পাওয়ার অনিশ্চয়তার ফলে নীরবে শ্রম শোষণ মেনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন অজিত কিংবা চন্দ্রার মতো অনেক শ্রমিক। কাজ করতে গিয়ে অনেককে সহ্য করতে হচ্ছে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনও।
চিংড়ি খাতে ঘের, হ্যাচারি ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা— এ তিন ধাপে কাজ হয়। ঘের ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় ছয় লাখ করে শ্রমিক রয়েছেন। আর চার লাখ নারী ও পুরুষ প্রাকৃতিক পোনা সংগ্রহের কাজ করেন। ঘেরে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিকই শিশু। ঘেরে একজন শ্রমিকের মাসিক আয় ২ হাজার ৫৮৮ টাকা। আর প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় এ আয় ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা। গড়ে প্রতি মাসে ১ হাজার ২৬ টাকা আয় করেন পোনা সংগ্রহকারীরা। পোনা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিতদের ৮ শতাংশেরই বয়স ১৫ বছরের নিচে বলে তথ্য উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
তবে এ প্রতিবেদনের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বাগদা চিংড়ি হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি উইং কমান্ডার (অব.) মইন উদ্দিন। তিনি বলেন, এ প্রতিবেদন সঠিক নয়। হ্যাচারিতে একজন চিংড়ি শ্রমিক ন্যূনতম সাড়ে ৪ হাজার টাকা মজুরি পান। সঙ্গে রয়েছে সাড়ে ৩ হাজার টাকা খাদ্য ভাতা। সব মিলিয়ে সাড়ে ৭ হাজার টাকা মজুরি পাচ্ছেন একজন শ্রমিক।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, চিংড়িঘেরে ৮৪ শতাংশ শ্রমিকই কোনো ছুটি পান না। সপ্তাহে সাতদিনই কাজ করতে হয় তাদের। সেখানে কর্মরত ৪ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিক ২১-২৪ ঘণ্টা, ৩ দশমিক ২ শতাংশ শ্রমিক ১৬-২০ ঘণ্টা ও ১২ শতাংশ শ্রমিক ১১-১৫ ঘণ্টা কাজ করেন।
চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানার অধিকাংশ শ্রমিক সাপ্তাহিক ছুটি পান না। সেখানে ৮৮ শতাংশ শ্রমিক সপ্তাহে সাতদিন কাজ করছেন। দীর্ঘ সময় এখানেও কাজ করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। সেখানে ১১-১৫ ঘণ্টা কাজ করছেন ৪৭ শতাংশ শ্রমিক। ২ দশমিক ৯ শতাংশ শ্রমিক ২১-২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। পিক সিজনে কোনো কোনো শ্রমিক ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন। গড়ে প্রতি শ্রমিককে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অন্যদিকে পোনা সংগ্রহকারীদের অধিকাংশ দৈনিক ৬-৮ ঘণ্টা কাজ করেন।
হ্যাচারি শ্রমিকরা কেউ বছরে একবার, কেউ ছয়বার পর্যন্ত ঋণ নেন। ঋণের পরিমাণ থাকে ২ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ শ্রমিক জানান, তাদের সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণ শোধের সক্ষমতা নেই ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিকের। ঋণ শোধ করতেই রাত-দিন কাজ করতে হয় তাদের। পোনা সংগ্রহকারী কারো কারো এক বছরে ১০টি ঋণ নেয়া হয়েছে। একটি পরিশোধ করতে নেন আরেকটি ঋণ। এভাবে ফড়িয়া ও মহাজনদের কাছে ঋণের জালে আটকে থাকেন শ্রমিকরা।
ঋণের বোঝা সামলাতে মালিকদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত কাজ করে দিতে হয় শ্রমিকদের। পোনা সংগ্রহকারীদের নোংরা কালো পানিতে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয় দীর্ঘ সময়। এতে বেশি থাকে সাপে কাটা ও কাঁকড়ার ভয়। অনেক শ্রমিক সাপের কামড়ে মারা গেছেন। ঘের ও প্রসেসিং প্লান্টে সারা দিনে বিশ্রাম মাত্র ১০ মিনিট। যারা ফ্রিজিংয়ের কাজ করেন, তাদের ক্ষতি হয় বেশি। নারীদের মূত্রনালি ও গাইনি অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়। চিংড়ি শ্রমিকরা প্রায়ই জ্বরে ভোগেন। চর্ম রোগও দেখা গেছে অনেকের মধ্যে।
শ্রমিকদের ঘের মেরামত, পাড় নির্মাণ, বেড়া তৈরি, রক্ষণাবেক্ষণ এমনকি পাহারাদারের কাজও করতে হয়। প্যাকেজিং হয়ে ফ্রিজে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে শ্রমিকরা কাজ করেন। তবে বেশির ভাগই মৌসুমি শ্রমিক। বেশি কাজ থাকে মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। মৌসুমি শ্রমিক নিয়োগ হয় ফড়িয়াদের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে আয়ের এক-তৃতীয়াংশই যায় তাদের পকেটে।বাংলাদেশ শ্রিম্প অ্যান্ড ফিশ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহমুদুল হক বলেন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও শ্রম আইন অনুযায়ী সর্বনিম্ন মজুরিও পাচ্ছেন না চিংড়ি শ্রমিকরা। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ কথা বলে আসছি।
কৃপ্র/এম ইসলাম