কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ভোলা জেলার আশ্রায়ণ প্রকল্প’র বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নত হচ্ছে। এখানকার ৭ উপজেলায় ১ হাজার ২শ’ ৬২টি ব্যারাকে ১০ হাজার ৮০টি পরিবার ক্রমশ আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে।সরকারিভাবে আশ্রয় পাওয়া এসব মানুষ পূর্বের দুরঅবস্থা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে সক্ষম হচ্ছেন। পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এখন হাঁস-মুরগি, কবুতর, গরু-ছাগল, মাছ চাষ, সবজি চাষের মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে স্বনির্ভরতা অর্জন করছেন।
এখন নিয়মিত স্কুলে যায় এখানকার ছেলে-মেয়েরা। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদান’র ফলে দক্ষ ও স্বাবলম্বী হচ্ছেন পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠী। তাই জেলায় ১০ হাজারেরও বেশি পরিবারের অর্ধকোটিরও অধিক মানুষ আশ্রায়ণ প্রকল্পে’র মাধ্যমে ভালো আছে। এখানকার প্রায় প্রত্যেককেই (যে যেই বিষয়ে আগ্রহী) প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সমাজের অসহায় ও দরিদ্র পরিবারের জন্য সরকারিভাবে আশ্রায়ণ প্রকল্প’র মাধ্যমে ঘর করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে ভূমিহীন পরিবারগুলোকে মাথা গোঁজার ঠাই হিসেবে এই প্রকল্পে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১শ’ ১৯টি ব্যারাকে ১ হাজার ১শ’ ৯০টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। দৌলতখান উপজেলায় ৪১টি ব্যারাকে ৩শ’ ২০টি পরিবার। বোরহানউদ্দিনে ৫৬টি ব্যারাকে ৪শ’ ১০টি পরিবার। তজুমুদ্দিনে ১ হাজার ৮শ’ ৯৫টি পরিবারের জন্য দেওয়া হয়েছে ২শ’ ৮১টি ব্যারাক।
একইভাবে লালমোহন উপজেলায় ২শ’ ৭২টি ব্যারাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৬শ’ ২০টি পরিবারকে। চরফ্যাসনে ৩শ’ ২৯টি ব্যারাকে ২ হাজার ৬শ’ ৩৫টি পরিবার ও মনপুরায় ১ হাজার ১০টি পরিবার পুনর্বাসিত করা হয়েছে ১শ’ ৬৪টি ব্যারাকের মাধ্যমে। প্রত্যন্ত এলাকার বিশেষ করে চরাঞ্চলে আশ্রায়ণ প্রকল্পগুলো এখন আদর্শ গ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে। বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে তাদের।
উপজেলা সদরের ভেলুমিয়া ইউনিয়নের চরগাজী এলাকার আশ্রায়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা দুল মোহাম্মদ (৪০)। নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে সব হারিয়ে ৫ বছর হলো এখানে বসবাস করছেন। পূর্বে অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করলেও বর্তমানে নিজে একটি অটোরিকশার মালিক। দৈনিক অটো চালিয়ে ৭শ’ থেকে হাজার টাকা লাভ হয় তার। আবার কখোনো কখোনো হজারের বেশি থাকে। তার স্ত্রী মিনারা বেগম (৩৬) গৃহের কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি ও ঘরের পাশের অল্প জমিতে সবজি চাষ করেন। তার ১৮টি দেশী মুরগি ও ১৫টি হাঁস রয়েছে। হাঁস-মসুরগির ডিম বিক্রি করে মাসে ভালো টাকা থাকে তার। তাদের একমাত্র মেয়ে সুমাইয়া আক্তার (১২) স্থানীয় স্কুলের পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র।
দুল মোহাম্মদ বাসস’কে বলেন, এক সময় নিজস্ব বসত-বাড়ি ও জায়গা জমিন থাকলেও নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়েছেন বহু আগে। গত ৫বছর যাবত গাজীর চর আদর্শ গ্রামে বাস করেন। বর্তমানে নিজ চেষ্টা ও পরিশ্রমে হারিয়ে যাওয়া স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছেন। ক্ষুদ্র ঋণ ও জমানো টাকায় একটি অটোরিকশা কিনে চালাচ্ছেন। এখন আর তার সংসারে অভাব নেই। এখানে ঠাই পেয়ে ভালো আছেন তিনি।
সরেজমিনে চরগাজী আশ্রায়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, মানুষের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে। পুর্বের হত-দরিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছে বহু পরিবার। এখানকার ২০টি ব্যারাকের ২শ’ ঘরে ২শ’টি পরিবার বসত করে। প্রতি ৩টি ঘরের জন্য একটি করে পাকা টয়লেট। বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য স্থাপন করা হয়েছে গভীর টিউবয়েল। ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়ার জন্য রয়েছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রত্যেক ঘরে পল্লী বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করছে। মাথার উপর ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা।
প্রায় প্রত্যেকের হাতে হাতে রয়েছে মোবাইল ফোন। অনেকের ঘরে টেলিভিশন। কারো কারো ঘরে স্যাটেলাইট’র লাইনও রয়েছে। ২শ’ পরিবারের সুবিধার্থে বিশালাকৃতির দুইটি দীঘি খনন করার হয়েছে। সবাই মিলে দীঘিতে রুই, কাতল, মৃগেল, তেলাপীয়া, চাইনিজ পুটিসহ মিশ্র মাছের চাষ করছেন। মাছ বিক্রি করে টাকা ভাগ করে নেন পরিবারগুলো। ব্যারাকের অঙিনায় ধান ভাঙ্গার কলে (যন্ত্র) অনেক পরিবারকে বোরো ধান থেকে চাল করতে দেখা গেছে।
৪নং ব্যারাকের সাধারন সম্পাদক বাবুল মাতাব্বর বাসস’কে বলেন, সমবায়’র মাধ্যমে এখানকার বাসিন্দাদের জন্য বিভিন্ন আর্থিক ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। এতে করে অনেকেই স্বালম্বী হচ্ছেন। তিনি নিজে ইলেকট্রিক কাজের পাশাপাশি কবুতরের খামার গড়ে তুলেছেন। তার এখানে প্রায় ১শ’ জোড়া (২০০) কবুতর রয়েছে। স্থানীয় বাজারগুলোতে কবুতরের বাচ্চার মাংস’র চাহিদা থাকায় প্রতি মাসে তার ভালো টাকা আয় হয় বলে জানালেন তিনি।
মো. হারুন মিয়া বলেন, তার মোট ১০টি গরু রয়েছে। তার মধ্যে ৩টি গরু দুধ দেয়। দৈনিক দুধ বিক্রি করে ভালো টাকা উপার্জন হয় তার। ২ ছেলেকে স্কুলে দিয়েছেন। এখন আর আগের মত অভাব নেই তার। আর লিটন মিয়ার গরু রয়েছে ৫টি । ফয়েজ আলির ৪টি। রাসেদ করিমের ৪টি, শুধু হারুন, লিটন, ফয়েজ নয়, এখানে অনেকেই গরু-ছাগল পালন করে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করেছেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষ করে কর্মে মনোনিবেশ করছেন অনেকে। হতদরিদ্র অসহায় পরিবারগুলো দারিদ্র্যতাকে জয় করতে শুরু করেছেন।
ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের আশ্রায়ণ প্রকল্প’র বাসিন্দা দিনমজুর মনির হোসেন’র স্ত্রী আরজু বিবি, ভ্যানচালক বিল্লাল হোসেন’র স্ত্রী লাইজু বিবি, রিক্সাচালক বাচ্চু মিয়া স্ত্রী রুমা আক্তার বাসস’কে বলেন, তারা সবাই হাঁস, মুরগি, গরু-ছাগল ও কৃষি কাজ করেন। স্বামীর উপার্জনের সাথে তাদের উপার্জন পরিবারের অভাব দূর করতে সহায়তা করছে।
জেলা প্রশাসক মো. সেলিমউদ্দিন বাসস’কে জানান, জেলায় আশ্রায়ণ প্রকল্প’র মাধ্যমে অসহায় ও দরিদ্র পরিবারগুলোকে পুনর্বাসিত করা হচ্ছে। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ফলে অনেক পরিবারই কর্মসংস্থানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে। তাদের পরিবার পরিকল্পনা সেবা, চিকিৎসা সেবা, বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সেবা দেয়া হচ্ছে। সরকারের এই প্রকল্প’র মাধ্যমে জেলার বিশেষ করে চরাঞ্চলের আশ্রয়হীন পরিবারগুলো নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছেন বলে ডিসি জানান।
সুত্রঃ বাসস/ কৃপ্র/এম ইসলাম