কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুরে অবস্থিত চা বাগান খৈয়াছড়া ডালু। ধারাবাহিকভাবে ভালো মানের চা উৎপাদনের ঐতিহ্য রয়েছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মালিকানাধীন বাগানটির। সর্বশেষ মৌসুমে দেশের সর্বোচ্চ গুণগত মানের চা উৎপাদন হয়েছে এ বাগানে। এর বিপরীতে মানসম্মত চা উৎপাদনের দিক থেকে পার্শ্ববর্তী আছিয়া চা বাগানের অবস্থান ছিল ৭৩তম। পাশাপাশি অবস্থান সত্ত্বেও মানে বৈপরীত্য দেখা গেছে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায় ক্লিভডন ও কাপনাপাহাড় চা বাগানের উৎপাদিত চায়ের ক্ষেত্রেও। মানসম্মত চা উৎপাদনের দিক থেকে এইচআরসি গ্রুপের মালিকানাধীন ক্লিভডনের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। অথচ পাশের বাগান কাপনাপাহাড়ের অবস্থান ছিল ৮১তে।
সব ধরনের প্রাকৃতিক সুবিধা থাকলেও তা কাজে লাগিয়ে ভালো মানের চা উৎপাদনে যেতে পারছে না দেশের অর্ধশতাধিক বাগান। অথচ পার্শ্ববর্তী বাগানগুলো শুধু দক্ষ লোকবল, উন্নত প্লাকিং ব্যবস্থা ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে মানের দিক থেকে এগিয়ে গেছে বহুদূর। মূলত ব্যবস্থাপনা ত্রুটি, উৎপাদন বাড়ানোয় অনীহা ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় অনাগ্রহের কারণে একই পরিবেশগত সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও ভালো মানের চা উৎপাদনে যেতে পারছে না দেশের সিংহভাগ বাগান। এতে চায়ের উৎপাদন কমার পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের মানের দিক থেকেও পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।
চা-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যবসায়ী জানান, চা বোর্ড শুধু উৎপাদন বাড়িয়েই বাহবা নিতে চাইছে। অন্যদিকে চা উৎপাদন করতে গিয়ে অপেশাদারিত্ব দেখাচ্ছে অধিকাংশ বাগান মালিক। গত কয়েক বছরে দেশে চায়ের উৎপাদন বাড়লেও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ভালো মানের চায়ের সংকট থাকায় পণ্যটি আমদানির দিকে ঝুঁকছেন ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে বাগান মালিকদের স্বার্থ রক্ষার নামে চা আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্কারোপের ফলে পর্যাপ্ত উৎপাদনের পরও দেশে চায়ের দাম বাড়ছে।
একই এলাকার বাগানগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মানের চা উৎপাদনের বিষয়টি স্বীকার করেন চা সংসদ, চট্টগ্রাম ব্রাঞ্চ কমিটির চেয়ারম্যান মমতাজুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, সব বাগানই ভালো মানের চা উৎপাদনে সক্ষম নয়। বাগান মালিকদের ইচ্ছার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে। একটি বাগানে চা উৎপাদনই প্রধান নয়। প্রক্রিয়াজাতের পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা না গেলে পরিবেশগত সুবিধাকেও কাজে লাগানো যায় না। তবে আমাদের দেশের বাগান মালিকরা আগের চেয়ে বেশি প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদনে মনোযোগী হয়েছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো গেলে বাংলাদেশেও বিশ্বমানের চা উৎপাদন সম্ভব হবে।
চা বিশেষজ্ঞ, বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান, ব্রোকার্স ও বাগান মালিকরা জানিয়েছেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় ভালো মানের চা উৎপাদনকারী বাগানগুলোর ব্যবস্থাপনা খুবই ভালো। অন্যদিকে কোনো কোনো বাগানে বড় ধরনের বিনিয়োগের পরও শুধু ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণেই কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে চা শ্রমিকদের অবহেলায় চায়ের প্লাকিং ত্রুটিপূর্ণ হলে চায়ের মানে প্রভাব পড়ে। দেশের শীর্ষস্থানীয় চা উৎপাদনকারী বাগানগুলোর আশপাশের অধিকাংশ বাগানই ভালো চা উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছে। চা বোর্ডের তদারকির মাধ্যমে এসব বাগানের ব্যবস্থাপনা ত্রুটি দূর করা গেলে পণ্যটির মানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এইচআরসি গ্রুপের চা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক মো. ইদ্রিস বলেন, চা বাগানের প্লাকিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ভালো মানের চায়ের কুঁড়ি উৎপাদন হলেও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে উন্নত মানের চা উৎপাদন সম্ভব নয়। নিত্যনতুন পদ্ধতির সংযাজন, শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ছাড়াও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানো গেলে পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে ভালো মানের চা উৎপাদন করা যায়। তবে পাশাপাশি বাগান হলেও অনেক বাগান প্রতিযোগিতায় ভালো চা উৎপাদনে ব্যর্থ হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন।
ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়া তথ্যমতে, ২০১৬ সালে দেশে প্রায় ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজি চা উৎপাদন হলেও ২০১৬-১৭ মৌসুমে নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৭ কোটি ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৮১ দশমিক ৯ কেজি। এর বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ৪৩৩ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ৬৪৭ টাকা। এর সঙ্গে ১০ শতাংশ ভ্যাট প্রদান করে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো চা বিপণন করেছে। এ হিসাবে দেশে চায়ের টার্নওভার ৫-৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দেশের রুগ্ণ বাগান মালিকরা ভালো মানের চা উৎপাদনে এগিয়ে এলে শুধু বাগানেই চায়ের বিক্রয়মূল্য ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এভাবে দেশের চা চাহিদা পূরণ হলে বিশ্ববাজার থেকে চা আমদানি কমে আসবে বলেও মনে করেন তারা।
দেশের সবচেয়ে ভালো মানের চা উৎপাদনকারী খৈয়াছড়া চা বাগানের পার্শ্ববর্তী হয়েও গুণগত মানে পিছিয়ে থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন আছিয়া চা বাগানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলম। তিনি বলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ছাড়াও চা উৎপাদনে ভালো করতে হলে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ জরুরি। একসময় আছিয়া বাগানে ভালো মানের চা উৎপাদনও হয়েছে। তবে খৈয়াছড়ার মতো বাগানগুলোয় বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি আধুনিক যন্ত্রপাতির সংযোজনে ভালো মানের চা উৎপাদনে এগিয়ে গেছে। চা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাগানগুলোকে ঋণসুবিধা দেয়া হলে রুগ্ণ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সুত্রঃ বনিক বার্তা/ কৃপ্র/এম ইসলাম