কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে চট্টগ্রামে বেআইনিভাবে পাহাড় কাটছে কয়েকটি সরকারি সংস্থা। এ কাজে পিছিয়ে নেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীরাও। পাহাড় কাটায় যোগ দিয়েছে ইমারত ও আবাসন নির্মাণ অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা অভিভাবক সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। মহানগর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটা অব্যাহত থাকলেও এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের। প্রতিবেদন দৈনিক বনিক বার্তা।
চট্টগ্রামের রাউজানে ‘পিংক সিটি আবাসন প্রকল্প’ নির্মাণ করছে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ। রাউজানের পাহাড়তলী এলাকায় ২০ একর জমিতে এই আবাসন নির্মাণে পাহাড় কাটছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের পাশে পাহাড়তলী চৌমুহনী বাজারের কাছে বদুপাড়া এলাকায় পিংক সিটির অবস্থান। প্রকল্পটির একদিকে মহাসড়ক আর তিন দিকে ফসলি জমি। প্রায় ২০ একর আয়তনের এ প্রকল্পে ২৭১টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের এ আবাসন প্রকল্পকে কেন্দ্র করে বেআইনিভাবে চলছে পাহাড় কাটা। এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাহাড়ের মাটি কেটে ট্রাকে ভর্তি করে পিংক সিটির জমি উন্নয়নের কাজ চলছে। রাউজান তাপবিদ্যুেকন্দ্রের বিপরীত দিকে একটি সুউচ্চ পাহাড় কেটে মাটি আনা হচ্ছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকার একটি পাহাড় থেকেও মাটি কাটা হচ্ছে। এসব মাটি দিয়ে পিংক সিটির জমি ভরাট করা হচ্ছে।
জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী একিউএম শাহজালাল মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাউজান পিংক সিটি-২ প্রকল্পের যথাযথ সরকারি অনুমোদন রয়েছে। এ প্রকল্পে মাটি ভরাটের কাজ দেয়া হয়েছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি বাইরে থেকে মাটি এনে প্রকল্পের জমি ভরাট করার কথা। প্রতিষ্ঠানটি পাহাড় কেটে মাটি ভরাট করছে কিনা, আমাদের জানা নেই। পাহাড় কেটে মাটি এনে প্রকল্পের জমি ভরাট করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ রাউজানের পার্শ্ববর্তী উপজেলা রাঙ্গুনিয়ার পোমরা এলাকায় পাহাড় কেটে ‘কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প’ বাস্তবায়ন করে চট্টগ্রাম ওয়াসা। গোডাউন এলাকায় পাহাড় কেটে সংস্থাটি পাইপলাইন স্থাপন করে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
পাহাড় কাটায় পিছিয়ে নেই ইমারত ও আবাসন প্রকল্প অনুমোদনের দায়িত্বে থাকা সংস্থা সিডিএ। দুই বছর ধরে সীতাকুণ্ড থানাধীন সিলিমপুর আবাসিক এলাকা প্রকল্পে পাহাড় কাটছে সংস্থাটি। জায়গা না থাকা সত্ত্বেও নতুন করে বরাদ্দ দেয়া প্লট গ্রাহকদের বুঝিয়ে দিতেই সিডিএ পাহাড় কাটছে বলে জানা গেছে। চট্টগ্রাম নগরীতে আবাসন অবকাঠামো নির্মাণ প্রস্তাব অনুমোদন করে সিডিএ। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই পাহাড় কেটে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এ সংস্থা।
সিডিএর সিলিমপুর প্রকল্পের পশ্চিম পাশের জলাভূমি ভরাটের কাজ চলছে। পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে এ জায়গা ভরাট করা হচ্ছে। জলাভূমি ভরাট করে সিডিএ ২০১৪ সালে তাদের বরাদ্দকৃত ৭০টি প্লট তৈরি করছে। সিলিমপুর আবাসিক এলাকার পূর্ব পাশের ২০০-৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় কাটা হচ্ছে। দুই বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে এ পাহাড়ের মাটি নিয়ে পশ্চিম দিকের জায়গা ভরাট চলছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে বরাদ্দ দেয়া প্রায় ১ হাজার ২০০ প্লটের সবগুলো সিডিএ এখনো আবেদনকারীদের বুঝিয়ে দিতে পারেনি। পাহাড় কেটে সেসব প্লটের জায়গা প্রস্তুত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মাসুদ করিম বলেন, ‘সিডিএর পক্ষ থেকে উঁচু-নিচু জায়গা সমান করতে আমাদের কাছে অনুমোদন চেয়ে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু উঁচু-নিচু জায়গা সমানের জন্য তো অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে না। এ প্রকল্পে পাহাড় কাটার কোনো অনুমোদন দেয়া হয়নি।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট থেকে নগরীর বায়েজিদ পর্যন্ত চার লেনের বাইপাস সড়ক নির্মাণ করছে সিডিএ। ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের বেশির ভাগ অংশ নির্মাণ করতে হয়েছে পাহাড় কেটে। সড়ক নির্মাণ ঘিরে পাহাড় কাটার সুযোগ নিচ্ছে স্বার্থান্বেষীরা। প্রায়ই সড়কের আশপাশের পাহাড় কেটে আবাসন তৈরি করা হচ্ছে। কোথাও ছিন্নমূল মানুষের নামে, আবার কোথাও বাগান অথবা বসতি নির্মাণের অজুহাত দেখিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় সাবাড় হচ্ছে এসব পাহাড়। দেখা যায়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের লেকসিটি আবাসিক এলাকার উত্তর দিকের পাহাড়গুলো নিঃশেষ করে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য আবাসন। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, জঙ্গল ছলিমপুর এলাকার প্রায় সব পাহাড় কেটে ধাপে ধাপে সেখানে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। মোটামুটি প্রতিদিনই সেখানে পাহাড় কাটার কাজ চলে। শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের স্থায়ী ক্যাম্পাস এলাকা বায়েজিদ থানার আরেফীন নগরেও বেশকিছু পাহাড় কাটা হয়েছে।
সিডিএ ভারপ্রাপ্ত প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহীনুল ইসলাম খান বলেন, ‘পাহাড় রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সিডিএর পক্ষ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে চিঠি লেখা হবে।’ এর আগে পাহাড় কেটে লেকসিটি নামে একটি আবাসন প্রকল্প নির্মাণের অভিযোগ ওঠে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে। পরে ২০১৪ সালে প্রকল্পটির কাজ বন্ধ করে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিডিএ।
লেকসিটি আবাসন প্রকল্প থেমে গেলেও সংলগ্ন এলাকায় পাহাড় কাটা থামেনি। লেকসিটি প্রকল্পের সীমানার বাইরে পূর্ব পাশে অনেক উঁচু পাহাড় কেটে স্থানীয় প্রভাবশালীরা সেখানে আবাসন প্রকল্প করছে। রেলওয়ে মালিকানাধীন এ পাহাড় কেটে আবাসিক প্লট তৈরির অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। লেকসিটি আবাসন প্রকল্পের পূর্ব পাশে বড় পাহাড়টির এক বিরাট অংশ কেটে এরই মধ্যে ২০টির বেশি প্লট তৈরি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম এ পাহাড় কাটায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে স্থানীয়রা জানান। তারা বলেন, কাউন্সিলর জসিমের নেতৃত্বে স্থানীয় প্রভাবশালী মো. আরিফ, জসিম উদ্দিন ওরফে মিনি জসিম, মো. সেলিমসহ কয়েকজনের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে পাহাড় কাটছে। এ বিষয়ে কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম বলেন, ‘লেকসিটি আবাসন প্রকল্পের কাজ কয়েক বছর ধরে বন্ধ। এ প্রকল্পের পাশে কারা পাহাড় কাটছে তা আমার জানা নেই। পাহাড় কাটার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
লেকসিটি প্রকল্পের পূর্ব পাশে টিন দিয়ে ঘেরা এলাকায় পাহাড় কেটে প্রায় ৮-১০ একর জায়গা সমান করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, চার-পাঁচ মাস ধরে ওই এলাকায় পাহাড় কাটা শুরু হয়েছে। রাতের আঁধারে এক্সক্যাভেটর দিয়ে চলে পাহাড় কাটার কাজ। ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ প্রভাবশালীরা এসব প্রকল্প নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। এমনকি প্লট ভাগাভাগিতে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন পক্ষের ভাগবাটোয়ারায় পাহাড় নিঃশেষ হলেও বিষয়টি অবহিত নয় জমির মালিক রেলওয়ে, নজরদারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিডিএ।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘ওই এলাকায় সিটি করপোরেশন ছাড়া অন্য কারো কাছে ভূমি লিজ অথবা বিক্রি করা হয়নি। ফয়’স লেকের পাহাড় ঘিরে কিছু বস্তি ছিল। বিভিন্ন সময়ের অভিযানে বস্তিগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে পাহাড় কেটে আবাসন প্রকল্প করার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ সিডিএ অথরাইজড অফিসার মনজুর হাসান বলেন, ফয়’স লেক এলাকায় পাহাড় কাটায় ২০১৪ সালে সিটি করপোরেশনের লেকসিটি প্রকল্প বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই এলাকায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আবাসন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়নি। এর পরও কেউ পাহাড় কেটে আবাসন প্রকল্প তৈরির চেষ্টা করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মাসুদ করিম বলেন, ‘পাহাড় কাটার অভিযোগ পেলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। সরকারি বা বেসরকারি যে প্রতিষ্ঠানেরই হোক, পাহাড় কেটে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে অনুমোদন নিতে হবে। শিগগিরই চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটার খবর নিয়ে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কৃপ্র/এম ইসলাম