ড. মো. হুমায়ুন কবীর: চিকুনগুনিয়া সর্বপ্রথম সনাক্ত করা হয় ১৯৫২ সালে আফ্রিকায়, পরে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এর বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশে ২০০৮ সালে প্রথম রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর ২০১১ সালে ঢাকার দোহার উপজেলায় এই রোগ দেখা গেলেও পরে বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি রোগী ছাড়া এই রোগের বিস্তার বাংলাদেশে আর খুব একটা দেখা দেয় নাই। কিন্তু এবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই এ রোগের প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিগত ৫০ বছরে চিকুনগুনিয়া রোগের আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও অতিবৃষ্টি অর্থাৎ এক কথায় জলবায়ু পরিবর্তন। জানা গেছে, গতবছর ভারতে এ রোগ আক্রান্ত হয়েছে ১২ লক্ষ মানুষ।
প্রকৃতিতে সব ধরনের রোগ এবং তার জীবণু সর্বদাই বিদ্যমান থাকলেও একেক সময় একেক রোগের জীবাণুর প্রাদুর্ভাবের কারণে কোন কোন রোগ মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে। তেমনই কিছু উল্লেখযোগ্য রোগ হলো- ম্যালেরিয়া, প্লেগ, বার্ড ফ্লু, ইবলা ভাইরাস, অ্যানথ্রাক্স, ডেঙ্গু, জিকা এবং সর্বশেষ চিকুনগুনিয়া। চিকুনগুনিয়াকে আঞ্চলিকভাবে ‘ল্যাংড়া জ্বর’ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। এডিস প্রজাতির এডিস ইজিপিট এবং এডিস এলবোপিকটাস প্রজাতিগুলোই চিকুনগুনিয়া রোগের কারণ। এগুলোর মধ্যে এনোফিলিস মশার কামড় থেকে যে ম্যালেরিয়া হতো সেই ম্যালেরিয়াকে এখন জয় করা সম্ভব হয়েছে। অন্যগুলো বিশেষ বিশেষ এলাকায় বিশেষ বিশেষ সময়ে প্রাদুর্ভাব ঘটাতে দেখা যায়। প্লেগ ইঁদুর কিংবা এ জাতীয় প্রাণী থেকে ছড়ায়। বার্ড ফ্লু ছড়ায় মুরগী এবং এ জাতীয় পাখি থেকে। অ্যানথ্রাক্স ছড়ায় দুষিত গরুর মাস থেকে। ইদানীং বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের কয়েকটি স্থানে অ্যানথ্রাক্স রোগের প্রদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। অপরদিকে ডেঙ্গু, জিকা এবং চিকুনগুনিয়ার সৃষ্টি হয় এডিস নামক এক প্রকার মশার কামড় থেকে।
এখন বর্ষাকাল। আর বর্ষাকালেই বেশি প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ডেঙ্গু, জিকা এবং চিকুনগুনিয়া নামক মশাবাহী ভাইরাসজনিত রোগের। এ রোগগুলো প্রাণঘাতী না হলেও এসব রোগের কারণে রোগীদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয় এবং প্রচুর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় কমপক্ষে প্রায় সপ্তাহখানেক সময় ধরে। কাজেই এখন বর্ষকালের এ সময়েই দেখা দিচ্ছে চিকুনগুনিয়া রোগ। এ রোগের কারণে কোন মৃত্যুর ঘটনা ঘটার নজির খুব কম হলেও তাতে অনেক কষ্ট আছে। এ রোগে আক্রান্ত হলে রোগীর শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টের হাড়ে মারাত্মক ব্যাথা অনুভূত হয়। শরীরে ভাইরাসজনিত জ্বরের কারণে বিরামহীন উচ্চ তাপমাত্রা বিরাজমান থাকে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে এডিস মশাই মূলত ডেঙ্গু, জিকা এবং চিকুনগুনিয়া রোগ সৃষ্টি করছে। তিনটি রোগের লক্ষণ মোটামোটি একই ধরনের হলেও ডেঙ্গু এবং জিকা থেকে চিকুনগুনিয়া রোগের ব্যাপারে আতঙ্কও একটু কম। কারণ ডেঙ্গু এবং জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্নয় করে চিকিৎসা শুরু করা না গেলে মৃত্যুও ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু চিকুনগুনিয়া রোগের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এ রোগের ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীর খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে, শরীরে মারাত্মক ব্যথা অনুভূত হয়, গিটে গিটে ব্যথা হয়, ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, শরীরে কাজের কোন শক্তি থাকেনা, সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয়। এতে কর্মমুখী মানুষের অনেক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। কারণ যাদের প্রতিদিন কাজ না করলে সংসারের আয় রোজগারের উপর প্রভাব পড়ে, তারা কর্মহীন হলে পরিবারের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
মৌসুম অনুযায়ী এখন সময় চিকুনগুনিয়ার। সারাদেশসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চিকুনগুনিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সম্প্রতি আইসিডিআিরবি’র একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এডিস মশার ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে ঢাকা শহরের মোট ২১টি স্থানে এ রোগের প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা ও ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। স্থানগুলো হলো- উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর, মধ্য বাড্ডা, গুলশান-১, লালমাটিয়া, পল্লবী, মগবাজার, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, রামপুরা, তেজগাঁও, বনানী, নয়াটোলা, পীরেরবাগ, কুড়িল, রায়ের বাজার, শ্যামলী, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর, মনিপুরিপাড়া, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, মিরপুর-১ এবং কড়াইল বস্তি প্রভৃতি। তবে সম্প্রতি সরকার এসব বিষয়ে যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। শুধু তাই নয়, ঢাকা মহানগরের দুটি সিটি করপোরেশনসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মিলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। শুধু ঢাকা নয় চট্টগ্রাম ,খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল মহানগরীসহ সারাদেশেই সকলকে সচেতনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে মশানিধন কার্যক্রম চালানোর জন্য সরকার থেকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
এখন চিকুনগুনিয়া এমন পর্যায়ে এসে গেছে যে, আমার সহকর্মীদের অনেকে যাঁরা ঢাকায় বসবাস করছেন, তাদের অনেকেই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। অনেকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করলে তারা বলছেন তাদের চিকুনগুনিয়ায় আক্রমণ করেছে। মৃত্যুর ভয় না থাকায় আতঙ্কিত না হওয়ার বিষয়ে বার বার সচেতন করা হলেও আক্রান্ত হলে কষ্টের কথা মনে করে মৃদু হলেও মনে আতঙ্কবোধ কাজ করছে। যেকারণে নাগরিকদেরকে অভয় দেওয়ার অংশ হিসেবে সরকারও অত্যন্ত তৎপর রয়েছে।
কাজেই যেহেতু চিকুনগুনিয়া রোগটি মরণঘাতী নয় সেজন্য মশা নিধনসহ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ থেকে নিরাপদে থাকা যেতে পরে। বাড়িঘরের মধ্যে অনেক সময় অনেকদিন পানি জমে থাকে ফলে সেখানে এডিস মশার উৎপত্তি হতে পারে। তাই বাড়ির ভেতরে, ছাদে, ড্রেনে, ফিজের পরিচ্ছন্ন পানি, নারিকেল ও ডাবের খোসার পানি, ভাঙ্গা বোতল ও হাড়ি-পাতিলের ভগ্নাংশে আটকে থাকা পানি- এসব যাতে জমে না থাকে সেদিকে জনগণকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে দিনের বেলাতেও মশারি খাটিয়ে ঘুমোতে হবে। আশেপাশের অপরিষ্কার ও ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার করে রাখতে হবে। নিয়মিত মশানাশক ব্যবহার করতে হবে। ডেঙ্গু সৃষ্টিকারী এডিস মশা শুধু স্বচ্ছ পােিনত বংশবৃদ্ধি ঘটালেও চিকুনগুনিয়া রোগ সৃষ্টিকারী এডিস মশা স্বচ্ছ ও ময়লা উভয় প্রকার পানিতেই বংশ বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। সেজন্য সবকিছুই পরিষ্কার রাখতে হবে।
এসব রোগে কোন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা যায় না। চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো শুধু জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধ সেবন করতে হবে। খুব বেশি সমস্যা হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে তদানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রোগীকে প্রচুর পানিসহ তরল খাবার খেতে হবে। সেইসাথে প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে। কোন অবস্থাতেই রোগের ক্ষেত্রে যেমন আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া যাবে না অপরদিকে অবহেলাও করা যাবে না। সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কারণ আমরা জানি, ‘প্রিভেশন ইজ বেটার দেন কিউর’। কাজেই মশার ঘনত্ব কমানোর জন্য নিজস্ব এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় মশা নিরোধক স্প্রে করতে হবে। এভাবেই মশাজনিত এসব মৌসুমী রোগ-বালাই থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়