কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ ইলিশের রাজধানী হিসাবে খ্যাত চাঁদপুর। কিন্তু সেই খ্যাতি সম্ভবত অতীত হতে চলেছে। এই ভরা মৌসুমেও পদ্মা-মেঘনা মোহনায় ইলিশের দেখা নেই। মাছ ধরা, বিক্রি ও রফতানির সঙ্গে জড়িতদের দিন কাটছে অনিশ্চয়তায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশের প্রজননক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়া, নদীতে পলি জমে নাব্যতা হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই আজ এ অবস্থা।
বহু বছর আগে চাঁদপুর শহরের ডাকাতিয়া নদীর তীরঘেঁষে গড়ে উঠেছে বড় স্টেশন মাছঘাট। তখন এ ঘাট ছিল ইলিশের বাণিজ্য কেন্দ্র। প্রতিদিন সকালে রুপালি ইলিশে সূর্যের ঝিলিক দেখা যেত, অনেক বেলা অবধি ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনায় সরগরম থাকত। প্রতি বছর বিপুল অংকের টাকার বাণিজ্য হতো। মাছঘাট থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট, টাঙ্গাইল, ঈশ্বরদী, পাবনা, দিনাজপুর, বগুড়া, যশোরে ইলিশ যেত। বেনাপোল সীমান্ত দিয়েও ভারতে ইলিশ রফতানি হতো।
কিন্তু কয়েক বছর ধরেই চিত্র পাল্টে গেছে। আগের সেই জাঁকজমক নেই। হতাশ ব্যবসায়ীরা বলছেন, অতীতের সেই দিন চাঁদপুর মাছঘাটে আর কখনো ফিরে আসবে না। চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছঘাটে প্রায় অর্ধশত মাছের আড়ত। এসব আড়তে মাছ ওঠা-নামানোর সঙ্গে জড়িত দু-আড়াই হাজার শ্রমিক। কিন্তু ব্যবসায়ী, পাইকার আর শ্রমিকদের হাঁকডাক নেই। একসময় ইলিশভর্তি শত শত ট্রলার এসে এখানে ভিড়ত। সেসব আর নেই।
জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল, হাইমচর উপজেলার ঈশানবালা, নীলকমল, চাঁদপুর জেলা সদরের আলুরবাজার, রাজরাজেশ্বর, লক্ষ্মীপুর, চেয়ারম্যান বাজার, পার্শ্ববর্তী শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলার জেলেরা পদ্মা-মেঘনার ইলিশ আহরণ করে এ ঘাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসতেন। বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত ইলিশের ভরা মৌসুম। অথচ আষাঢ়ের শুরু হলেও চাঁদপুর মাছঘাট প্রায় ইলিশশূন্য। ফলে হাজার হাজার টাকা বিনিয়োগ করে লোকসানের হিসাব কষতে বসেছেন জেলে ও ব্যবসায়ীরা।
এদিকে চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজেন্ডার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নৌপথ ইলিশের অভয়াশ্রমের আওতায় নিয়েছে সরকার। মার্চ-এপ্রিল দুই মাস এ এলাকায় জাল ফেলা নিষিদ্ধ। যদিও কিছু অসাধু জেলে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মা ইলিশ ও জাটকা ধরে।
চাঁদপুর মত্স্য বণিক সমিতির সভাপতি আলহাজ মিজানুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, আষাঢ়ের শুরু থেকে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ার কথা। কিন্তু নেই। জাটকা রক্ষায় সরকারের কার্যক্রম সঠিকভাবে পালন হলেও অসাধু কিছু কর্মকর্তাদের কারণে ভেস্তে যায়। অনেক জেলে কার্ড পাওয়ার পরও জাটকা ধরেন। সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলী গাজী অতীত স্মৃতিচারণ করে বলেন, একসময় এ মাছঘাট থেকে হাজার হাজার মণ ইলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে রফতানি করা হতো। আর এখন দু-একটা ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের ভোলায়। সেই মাছ চাঁদপুর বড় স্টেশন মাছঘাটে আনা হচ্ছে।
সারা ঘাটে এখন ১০০ মণ ইলিশও আসছে না। অথচ আগে একেকটি মোকাম ঘরে শত শত মণ ইলিশ আসত। ছোট ট্রলার ও নৌকাযোগে যে ইলিশ চাঁদপুর মাছঘাটে আসছে সেগুলোর বেশির ভাগই দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল, ভোলা, চরফ্যাশন এলাকার নদীতে ধরা মাছ। স্থানীয়ভাবে এসব ইলিশ ‘নামার’ মাছ হিসেবে পরিচিত। জেলা মত্স্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালেও চাঁদপুরে ২০ হাজার ৪০০ টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। এর মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা, যা গত পাঁচ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ।
নদীতে ইলিশ না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাঁদপুরের ইলিশ গবেষক ড. আনিছুর রহমান বলেন, চাঁদপুরের নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় আষাঢ়ের মৌসুমে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার যদি চাঁদপুরের নদীগুলোর নাব্যতা বৃদ্ধি করে, তাহলে হয়তো আগের মতো আষাঢ়ে জেলেদের জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ত। আগের রূপ চাঁদপুর মাছঘাটে ফিরিয়ে আনতে হলে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার গভীরতা বাড়াতেই হবে। তাছাড়া মা ইলিশ চাঁদপুর ষাটনল থেকে চর আলেকজান্ডার থেকে বিচরণ করে ডিম ছেড়ে আবার সমুদ্রে চলে যায়। এর জন্যও চাঁদপুর নদীগুলোয় ভরা মৌসুমে ইলিশের দেখা পাচ্ছেন না জেলেরা। তিনি আরো বলেন, ইলিশ পরিভ্রমণপ্রিয় মাছ। দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা নিম্ন এলাকা থেকে ডুবোচরের কারণে আর উপরে উঠে আসতে পারছে না।
কৃপ্র/এম ইসলাম