এম আব্দুল মোমিন ও মনিরুজ্জামান কবীর: বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের যেদিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর মনকাড়া চিত্র বৈচিত্র্যে ভরা। যে মৌসুমই আসুক না কেন সবুজ আর সজীবতার যেন শেষ নেই। আর এর মধ্যেও আছে নানা বৈচিত্র্যের সমাহার। কেউ কি আমরা খুঁজে দেখেছি সেসব বৈচিত্র্যময় বিচিত্রতাকে। কতজন চোখ মেলে দেখেছি_ ‘ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে, কোথায় এমন হরিৎ ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে’। কিংবা সকালের দিকে ধানের ফুল ফোটার শব্দ কেউ কি কান পেতে শুনেছি? কেউ কি দেখেছি সকালের সূর্যোদয়ের সময় ধান ক্ষেতের পশ্চিমে দাঁড়িয়ে পুবের দিকে মাকড়শার জালের অপূর্ব কারুকার্য! কিংবা শীতকালীন সবজি ক্ষেতে সকালের শিশির বিন্দু। হয়তো দেখেছি আসা-যাওয়ার পথে। কিন্তু দেখিনি দেখার মতো করে। মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনা করিনি কোনো কিছুর সঙ্গে।
কৃষি বলতে আমরা ধান, পাট, আখ ইত্যাদি দানাদার শস্যের সঙ্গে ফুল, ফল, শাক-সবজির চাষ, মৎস্য চাষ ও গবাদিপশু পালনকে বুঝি। কিন্তু আধুনিক কৃষি গতানুগতিক চাষাবাদ থেকে ভিন্ন কিছু। বাংলাদেশে ৩০টি এগ্রোইকোলজিকাল জোন (অঊত, অমৎড় ঊপড়ষড়মরপধষ তড়হব) একেকটি বা একাধিক ফসল বা কৃষি পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। দিনাজপুরের লিচু ভালো, রাজশাহীর আম, সিলেটের চা ভালো, পার্বত্য চট্টগ্রামের জাম। নরসিংদীর কলা ভালো, বগুড়ার দই। একেক অঞ্চল একেকটি ঐতিহ্যবাহী ফসল নিয়ে কৃষি পর্যটন হতে পারে। শহরের তরুণরাও এসব স্পটে দল বেঁধে ভ্রমণ করতে পারে। এতে তারা কৃষির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে পাশাপাশি, প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটিয়ে নির্মল আনন্দ পাবে।
কৃষি পর্যটনের ধারণা : প্রথমত, কৃষি পর্যটন ব্যাপারটি আমাদের দেশে নতুন হলেও উন্নত দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে। ব্যাপারটি সহজ করে ব্যাখ্যা করলে এমন দাঁড়ায় শহরের ছেলে-মেয়েরা স্ট্রবেরি পছন্দ করে কিন্তু কীভাবে কোন গাছে স্ট্রবেরি উৎপন্ন হয় তা জানে না। আলু কীভাবে ধরে, মাটির নিচে না ওপরে তা দেখেনি। তাছাড়া প্রত্যেক গ্রামেই কিছু কৃষক ও তরুণ রয়েছেন, যারা কীটনাশকবিহীন ফসল উৎপাদন করে ও ফসল বিক্রি করতে পারছেন না অথবা কম দামে বিক্রি করছেন শুধু প্রচারের পাদপ্রদীপের নিচে না আসতে পেরে।
তাছাড়া উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশে বিশাল আকৃতির কৃষি ফার্মও গড়ে উঠছে না, কৃষি পর্যটনের অভাবে। একটি উদাহরণ বিষয়টি আরও স্পষ্ট করবে। আমের রাজধানী রাজশাহী, লিচুর জন্য বিখ্যাত দিনাজপুর। এখন আম ও লিচুর ভরা মৌসুম। এই ছুটিতে বিষমুক্ত টাটকা আম ও লিচু খেতে দল বেঁধে চলে যেতে পারেন রাজশাহী ও দিনাজপুর। এতে একদিকে যেমন টাটকা আম বা লিচু খাওয়া হবে অন্যদিকে এগুলোর চাষবাদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ হবে। ব্যাপারটি অনেকটা রথে গিয়ে কলা বেচা আর মেলা দেখার মতো। আর নিজ হাতে বাগান থেকে পাকা আম ছিঁড়ে খাওয়ার আনন্দ যে কেমন কেবল সেই জানে যে বাগানে গিয়ে পছন্দমতো টসটসে পাকা আম ছিঁড়ে খেয়েছে। আবার ধরুন কালোজিরা ধানের চাষ কুমিল্লায় ভালো হয় আবার কাটারি চাল দিনাজপুরে। ঈদের ছুটিতে কুমিল্লা বা দিনাজপুরে দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসুন। জেনে ও দেখে আসুন কালোজিরার চাষাবাদ ও উৎপাদন পদ্ধতি। ফেরার সময় উপঢৌকন হিসেবে পরিবারের সদস্যদের জন্য বা শহুরে বন্ধু ও স্বজনের জন্য কয়েক কেজি নিয়ে আসুন সঙ্গে করে। দেখবেন এর চেয়ে খুশি আর কিছুতেই হবে না তারা।
অনেক বন্ধু ও ছোট ভাইকে দেখেছি ইলিশের ভরা মৌসুমে পদ্মার চর, মাওয়াঘাট ও চাঁদপুরে চলে যেতে টাটকা ইলিশ খেতে। তার চেয়ে ভালো উপায় কী আছে। বাসায় যতই সর্ষে ইলিশ খান, পদ্মার ধারে মাওয়াঘাটে বসে পছন্দসই ইলিশ পছন্দের মসলায় রান্না বা ভাঁজা খাওয়ার মজাটাই অন্যরকম। এটি শুধু ইলিশ খাওয়া নয়, দেশের একটি ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। বর্তমানে অনেক ইনোভেটিভ কৃষক অর্গানিক ও কীটনাশকবিহীন প্রযুক্তিতে ধান, শাক-সবজি, ফুল, ফসল ও মৌমাছি চাষ করছে। অনেক কৃষক ও তরুণ আধুনিক কৃষি ফার্ম গড়ে তুলেছেন। এসব ফার্ম ভ্রমণের মাধ্যমে ক্ষেত থেকে সদ্য তোলা বা সদ্য পাড়া কৃষিপণ্য বা ফল-ফলাদি খাওয়ার ও ক্রয়ের আনন্দ পাবেন উৎসুক পর্যটকরা। এতে দেশে কৃষি ও কৃষক লাভবান হবে। সর্বোপরি কৃষক ও দেশের প্রতি তরুণ সমাজের ভালোবাসা জন্মাবে।
কৃষি পর্যটনের স্পট : কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, মসলা গবেষণা ইনস্টিটিউট, আম গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নয়নাভিরাম ক্যাম্পাস, জার্মপ্লাজম সেন্টার, জিনব্যাংকসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও সর্বশেষ উদ্ভাবিত কৃষি কলাকৌশল ও জাতের সঙ্গে পরিচিত হওয়া; বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান (যেমন : প্রাণ) কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্লান্ট পরিদর্শন করা কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনাময় স্পট হতে পারে।
আমাদের সারাদেশে ছড়িয়ে আছে প্রায় ৫০০-র কাছাকাছি হাওর-বাঁওড়, হাজারো বিল-ঝিল দীঘি জলসাগর। এসব জলাশয়ে আধুনিক জলযানে ঘুরে বেড়ানো, পাখি দেখার ব্যবস্থা, মাছ ধরার সুবিধা, জেলেদের সঙ্গে মাছ ধরার সুযোগ, নৌকা বাইচের ব্যবস্থা, নৌকা চালানো এসব; মৌমাছি পালনকারীদের মধু সংগ্রহ দেখা ও টাটকা মধু খাওয়া, স্বল্পমূল্যে পর্যটকদের কাছে বিক্রির ব্যবস্থা করা পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ফল ধরার মৌসুমে ভাগ ভাগ করে ফুল ফোটা বা মুকুল ধরা দেখা, পাকা ফলের বাগানে ঘুরে বেড়ানো, এমনকি মৌসুমের একটি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বাগানেই যত খুশি ফল খাওয়ার সুযোগ করে দেয়া; রকমারি সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটা সবজিক্ষেত পরিদর্শন করা, আন্তঃপরিচর্যা, সংগ্রহ ও সবজির চাষ কৌশল দেখা; নিজে সংগৃহীত সবজি পুষ্টিসম্মত উপায়ে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা রাখা; দেশের বিভিন্ন স্থানের হর্টিকালচার সেন্টারের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ ও অন্যান্য চলমান কার্যক্রম পরিদর্শন করা; চরের কৃষি ও চরের সংগ্রামী মানুষের কৃষি কর্মকা- পরিদর্শন করা এবং তাদের সঙ্গে কাজে অংশগ্রহণ করা। বিশেষ করে বন্যার পরে চরে পলিপড়া মাটিতে হেঁটে বেড়ানো; চা-বাগান পরিদর্শন ও চা প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি দেখা, যে কোনো বড় বিশেষ উল্লেখযোগ্য কৃষিখামার পরিদর্শন; পাহাড়িদের কৃষির সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও তাদের কাজের সঙ্গে অংশগ্রহণ করা; অটোমেটিক রাইস মিল, হিমাগার, চিনি-কারখানা, মুড়ির কারখানা, চিড়ার কারখানা পরিদর্শন; কোনো সফল কৃষকের কর্মকা- পরিদর্শন, তার সফলতার কাহিনীর বর্ণনা শোনা।
প্রয়োজন উদ্যোগ : কৃষি পর্যটনের বাংলাদেশ এই ধারণাটি বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয়, পর্যটন মন্ত্রণালয় ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কৃষি ট্যুরিজম নামক একটি ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপস তৈরি করা যেতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের উপজেলা কৃষি অফিসার ও প্রত্যেক গ্রামের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বা বস্নক সুপারভাইজারের মাধ্যমে কোন এলাকায় কি ভালো হয়, কোন এলাকায় কে অর্গানিক বা বিষমুক্ত চাষাবাদ করছে তার একটা ডাটাবেজ তৈরি করতে পারে। যেমন_ রাজশাহীতে কবে আম পাড়া শুরু হবে, বিল বা হাওরে কোন দিন মাছ ধরার উৎসব হবে, কোন মাসে বা সময়ে পদ্মায় ইলিশের ভর মৌসুম থাকবে এসব তথ্য আগেই ওয়েবসাইটে আপলোড করবেন।
অন্যদিকে পর্যটন মন্ত্রণালয় ওই এলাকায় কীভাবে কম খরচে বা স্বাচ্ছন্দ্যে মানুষ যাবে, কোথায় থাকার ব্যবস্থা আছে, ভাড়া কত ইত্যাদি তথ্যাদি ওয়েবসাইটে লিপিবদ্ধ করবে। আর আইসিটি মন্ত্রণালয় ওইসব এলাকা থেকে ছবি ও ভিডিও এনে একটি সুন্দর ইভেন্টভিত্তিক ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপস ডেভেলপ করবে। এতে শুধু সিলেট বা পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, কৃষি পর্যটন এলাকা হবে পুরো বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে ওয়েবসাইটে প্রত্যেক এলাকার আধুনিক ফার্ম ও সেখানে একদিন থাকার মতো ব্যবস্থা থাকলে তা উল্লেখ থাকবে। অথবা এই ওয়েবসাইটে একটি পূর্ব ঘোষণা দিয়ে নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করে দেবে, আগামী জ্যৈষ্ঠ বা মধু মাসের ২,৩ ও ৪ তারিখ আমরা আমের রাজ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী আম বাগান পরিদর্শনে যাব।
আগ্রহীরা রেজিস্ট্রেশন করে যোগ দিতে পারেন। এভাবে দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী কাটারিভোগ চাল চাষ। পাবনার পেঁপে বাদশার পেঁপে বাগান। যশোরের গদখালীর ফুল চাষের বিস্তৃতি এলাকা। পাহাড়ি এলাকার জুম ও মাল্টা চাষ। হবিগঞ্জ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, ফরিদপুর ইত্যাদি এলাকার গভীর জলের ধান চাষ। মুন্সীগঞ্জে রবি মৌসুমে আলু চাষ। হাওরে জোৎস্না দেখা ও মাছ মারা ইত্যাদি ইভেন্ট খোলা যেতে পারে।
কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনা : সব বয়সী মানুষের মধ্যেই গ্রাম ও প্রকৃতির প্রতি আলাদা আকর্ষণ আছে। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে কৃষির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের স্পৃহা বাড়ছে দিন দিন। মানুষ শিকড়মুখী হতে চায়, পুকুরে সাঁতার কাটতে চায়, নিজ হাতে মাছ ধরতে চায়, গাছ থেকে ফল-ফলাদি পেড়ে খেতে চায়। যতই দিন যাবে মানুষ অর্গানিক আর বিষমুক্ত কৃষিপণ্যের চাহিদা বাড়বে। এই কারণে অদূর ভবিষ্যতে মানুষ ওয়েবসাইট বা অ্যাপস ঘেঁটে তার আশপাশের কৃষি ও কৃষ্টির দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করতে চাইবে।
আর তরুণ উদ্যোক্তারা এই সুযোগটি লুফে নিবেন ব্যবসার জন্য। একটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশকে ঘিরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম ও বিনোদন আবর্তিত হবে। এতে ক্রেতা ও কৃষক উভয়ই উপকৃত হবেন। যেমন-ভোক্তার কাছে সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন। আশা করা যায় কৃষি পর্যটনের ধানাটি বাস্তবায়িত হলে আগামী ৫-১০ বছরে দেশের কৃষি ও কৃষকের অবস্থার একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে। কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ হবে। এ ধারণা বাস্তবায়িত হলে অনেকেই চাকরি শেষে অবসরকালীন সময়ে গ্রামে চলে গিয়ে কৃষি ফার্ম গড়ে তোলায় মনযোগী হবেন। এতে মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তির পাশাপাশি জীবন ধারণের অভ্যাসজনিত কিছু রোগবালাই যেমন; বয়স্কদের ডায়বেটিক ও হৃদরোগের হার কমে আসবে। পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
লেখকগণ : কৃষিবিদ ও কৃষি সাংবাদিক
কৃপ্র/ এম ইসলাম