কৃষিবিদ এম. আব্দুল মোমিন
ছবি দেখে মনে হতে পারে ফটোশপ করা ধানক্ষেত বা দূর থেকে দেখে মনে হবে ধানের ক্ষেতে বুঝি কোনো রোগ লেগেছে অথবা পোকার আক্রমণে সারাক্ষেতের ধান বেগুনি হয়ে গেছে। আসলে এর কোনটিই নয়। এটি এমন একটি ধানের জাত, যার পাতার রঙটাই বেগুনি। শুধু কি পাতার রঙ, ধানের ও চালের রঙও বেগুনী বা পার্পল হতে পারে। তাই কৃষকদের কাছে এখন পর্যন্ত্ম এই ধানের পরিচিতি বেগুনি রঙের ধান বা পার্পল রাইস। সব থেকে বড় কথা এটা বিদেশি কোনো জাত নয়, আমাদের দেশি ধানের জার্মপস্নাজম।
কুমিলস্না আদর্শ সদর উপজেলার মনাগ্রামের কৃষক মঞ্জুর হোসেন এলাকায় পাম মঞ্জুর নামেই অধিক পরিচিত। তিনি ওই এলাকার একজন সফল কৃষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করেও তিনি কোনো চাকরির ধার ধারেননি। কৃষিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে পাম চাষ করে পাম ফল হতে তেল উৎপাদন করেন। এ ছাড়া নিজস্ব মেশিনে সরিষার তেল ও খৈল উৎপাদন করেন। তার রয়েছে মাছের এবং গরম্নর খামার। দেশের প্রত্যন্ত্ম অঞ্চল ঘুরে ঘুরে নানা ফসল ও ফলের জাত সংগ্রহ করে নিজের বাগানে চাষ করাই তার শখ। সে শখের বশেই চলতি বোরো মৌসুমে ৪ (চার) শতাংশ জমিতে করেছেন পার্পল ধানের চাষ।
তার ভাষ্য মতে, গত বোরো মৌসুমে সুন্দরবন যাওয়ার পথে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার একটি জমিতে বেগুনি রঙের কিছু ধান গাছ দেখতে পান। জিনিসটা কি ছিল তা ভাবতে ভাবতেই বিশ কিলোমিটার চলে যান। কিন্তু কৌতূহল দমাতে না পেরে সেখানে বাস থেকে নেমে ফিরে আসেন এবং খুঁজে বের করেন জমির মালিক কৃষক লাল মিয়াকে। লাল মিয়ার কাছ থেকে জানতে পারেন আগের বছর তার বোরো ধানের ক্ষেতে কয়েকগুছি বেগুনি ধানের গাছ দেখতে পান। কিন্তু বীজগুলো কোথা থেকে এলো তা তিনি জানতেন না। ধান কাটার পর তিনি বীজগুলো আলাদা করে সংগ্রহ করেন এবং গত বছর
সে বীজ দিয়ে সামান্য জায়গায় চাষ করেন। তিনি জানান, তার কাছে আর কোনো বীজ নেই। কৌতূহলী মঞ্জুর হোসেন এতে দমে যাননি। বরং ১০০০ টাকা অগ্রীম বুকিং দিয়ে আসেন কুরিয়ারে কিছু বীজ পাওয়ার আশায়। অবশেষে তিনি কুরিয়ারে ২৫০ গ্রাম বীজ হাতে পান।
স্থানীয় বস্নকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ছালেকুর রহমান শামীমের পরামর্শ মোতাবেক তিনি অত্যন্ত্ম যত্নসহকারে পেট্রিডিসে অঙ্কুরোদ্গম করে তারপর বীজতলায় ফেলেন। পরে ৪০ (চলিস্নশ) দিন বয়সের চারা প্রতি গুছিতে একটি করে দিয়ে ৪০ শতাংশ জমিতে রোপণ করেন। বর্তমানে চারার বয়স ১১৪ দিন। প্রতি গুছিতে ১০-১৪টি কুশি রয়েছে। গাছের উচ্চতা ৮০ সে.মি.। গাছ থোড় অবস্থায় (ইড়ড়ঃরহম ংঃধমব) আছে। ধান গাছগুলো গাঢ় বেগুনি রঙের। কিন্তু কচি পাতাগুলো সবুজ রঙের যা পর্যায়ক্রমে পার্পল রং ধারণ করে। এই কৃষক জানান, তিনি প্রথমে বিষয়টি কাউকে জানাতে চাননি। এ বছর সফলভাবে বীজ উৎপাদন করে পরেরবার সবাইকে জানানোর ইচ্ছা ছিল তার। তবে একটি পত্রিকায় তার এই ব্যতিক্রমী ধানক্ষেতের ছবি ও খবর ছাপা হলে বিষয়টি সবার নজরে চলে আসে। তিনি জানান, তার পার্পল ধানের জমিটি এখন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং ব্রির বিশেষ পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
সম্প্রতি কৃষক মঞ্জুর হোসেনের পার্পল রাইসের জমিটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং ব্রির বিজ্ঞানীরা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন দলে ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুমিলস্না অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাহেদুল হক, অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্যান) তারিক মাহমুদুল ইসলাম, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ছালেকুর রহমান শামীম ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কুমিলস্না আঞ্চলিক অফিসের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল মোতালেব। তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ের অবস্থা বিবেচনায় ধানটির জীবনকাল কম-বেশি ১৫৫ দিন এবং ফলন আনুমানিক শতাংশে ২০ কেজি (৪-৫ টন/হেঃ) হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন চালের রং বেগুনি হলে ধানটি উচ্চমূল্যের হবে। তবে কৃষক মঞ্জুর জানান, সংগ্রহকালীন সময়ে চালের রং অন্যান্য উফশী জাতের মতোই দেখেছেন। তাই সমস্ত্ম বিষয় জানতে ধান কাটা পর্যন্ত্ম অপেক্ষা করতে হবে। মজার ব্যাপার হলো, মঞ্জুর হোসেন সাতক্ষীরার যে কৃষকের কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করেছিলেন সে কৃষকের নিজের জন্য সংরক্ষিত বীজ ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে বলে জানান। তিনি পুনরায় মঞ্জুর হোসেনের কাছ থেকে বীজ পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
সুত্র, যায়যায় দিন/ কৃপ্র/এম ইসলাম