একেএম দেলোয়ার হোসেন।।
বর্তমানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে মোট ১৫টি চিনিকল চালু রয়েছে, যার মধ্যে তিনটি ব্রিটিশ আমলে, নয়টি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্ত্মান আমলে এবং তিনটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থাপিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গে সবচেয়ে পুরনো চিনিকল হলো নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল, যা ১৯৩৩ সালে তৈরি করা হয়েছিল; কিন্তু নাটোর ও পাবনা অঞ্চলে যে আখ উৎপাদন হতো, তা নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল থেকে অনেক দূরে হওয়ায় পরিবহনে অসুবিধা হতো এবং অনেক আখ নষ্ট হয়ে যেত বলে পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাটোর চিনিকলটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে এবং পাবনা চিনিকলটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। এ চিনিকলগুলো তৈরির সময় কোনো কোনো জায়গায় জমির মালিকানা ছেড়ে দিয়ে কাউকে অন্যত্র চলে যেতে হয় আবার অনেক মানুষ অন্য অঞ্চল থেকে অভিবাসন করে এ এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরম্ন করে।
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলটি যখন তৈরি করা হয়, তখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক কৃষক ও শ্রমিক আখ চাষ করার জন্য ও শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য উত্তরবঙ্গে অভিবাসন করে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরম্ন করে। তাদের অনেকেই আর ফেরত যায়নি এবং তাদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পপ্রন্ম এখনো খামারে কাজ করছে। অন্যদিকে রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকলটি নির্মিত হয় পাকিস্ত্মান আমলে ১৯৫৫ সালে।
সে সময় রংপুর চিনিকল নিজস্ব খামারের জন্য ১৯৫৪-৫৫ অর্থবছরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৫নং সাপমারা ইউনিয়নের সাপমারা, রামপুর, মাদারপুর, নরেঙ্গাবাদ ও চকরাহিমপুর মৌজার ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করেছিল। এলাকাটি এখন সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম নামে পরিচিত। বাংলাদেশের চিনিকলগুলোয় বর্তমানে সরাসরি প্রায় ২২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান।
২০০২ সালের আগ পর্যন্ত্ম বিএসএফআইসি কর্তৃক এককভাবে চিনি উৎপাদন ও আমদানি করে দেশব্যাপী বিস্ত্মৃত বিপণন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নির্ধারিত দরে সুষ্ঠু বিপণনের মাধ্যমে ভোক্তাসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণ করে আসছিল। যদিও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান সরকার আবার বিএসএফআইসির মাধ্যমে চিনি আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন। ২০০২ সালে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে চিনি আমদানি অবাধ করা হয় (বিএসএফআইসি, ২০১৪)।
বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিকারকরা সাদা চিনি আমদানি করে বাজারজাত শুরম্ন করে। পরে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধিত চিনি উৎপাদনের জন্য সরকারের নিবন্ধিত ছয়টি সুগার রিফাইনারি ২০০৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে উৎপাদনে আসে। ২০০২ সালে বেসরকারি উদ্যোগে চিনি আমদানি অনুমোদনের মধ্য দিয়ে শুরম্ন হয় চিনি শিল্প উদারীকরণ। ২০০৪ সাল থেকে রিফাইনারিগুলো উৎপাদনে আসার আগে নিবন্ধনপত্রে শর্ত রয়েছে, উৎপাদিত পণ্যের ৫০ শতাংশ রফতানি করা হবে (বিএসএফআইসি, ২০১৪)। কিন্তু এ শর্ত প্রতিপালিত হচ্ছে না।
উপরন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত র সুগার আমদানি করার সময় মূলত দুটি যুক্তি দেয়া হয়। ১. বেসরকারি রিফাইনারিগুলো বাড়তি র সুগার আমদানি করে দেশে রিফাইন করে বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে। ২. বেসরকারি রিফাইনারিগুলো এ বাড়তি মজুদ করা চিনি প্রয়োজনের সময় বাজারে ছেড়ে চিনির মূল্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।
কিন্তু দেখা গেছে, এ প্রাইভেট রিফাইনারিগুলো বিদেশে তো রফতানি করছেই না, বরং স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দেশের ১৫টি চিনিকলে উৎপাদিত চিনির বাজারের কাছে হুমকিস্বরূপ আবির্ভূত হচ্ছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাক সে কথা। একটা বিষয় হয়তো আমাদের জানা নেই যে, গোটা বিশ্বে ৮০ ভাগ চিনি উৎপাদন হয় আখ থেকে আর ২০ শতাংশ হয় সুগার বিট থেকে। কারণ আখের চিনি হলো স্বাস্থ্যসম্মত ও মানব দেহের জন্য উপকারী। অপরদিকে পরিশোধিত চিনি হয় সম্পূর্ণ কৃত্রিম উপায়ে, যার মিষ্টির কোনো মৌলিক ভিত্তি নেই।
বর্তমান শিল্পবান্ধব সরকারও এখন এই শিল্পের ওপর গুরম্নত্ব দিয়ে নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করছে। চিনির পাশাপাশি এই শিল্পকে ঘিরে বেশকিছু সহযোগী প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হচ্ছে। এতে করে এই শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি অনেক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন/ কৃপ্র/এম ইসলাম