ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার , মোহাম্মদ মেহেদি আকতার।।
স্লো বাট স্টেডি উইনস দ্য রেস’ ইশপের গল্পটি কে না শুনেছেন! গল্পটি শুনলেই যে প্রাণীর কথা মনে পড়ে, সেটি হলো কচ্ছপ। ধরিত্রীর সবচেয়ে প্রাচীন প্রাণীদের মধ্যে কচ্ছপ অন্যতম। পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। সাধারণত কচ্ছপরা দীর্ঘজীবী হয়। এদের গড় আয়ুষ্কাল ১৯০ বছরেরও বেশি। বেঁচে থাকা দীর্ঘজীবী একটি কচ্ছপ হলো ‘জনাথন’। ভারতের আলীপুর চিড়িয়াখানার কর্মকর্তাদের মতে, সবচেয়ে বেশি বয়সের কচ্ছপ হলো ‘আদৃতা’। এটি প্রায় ২৫৫ বছর বেঁচে ছিল। কচ্ছপের দীর্ঘায়ু নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৃদ্ধ বয়সে বিপাকক্রিয়া খুব ধীরগতির হওয়ায় তাদের শক্তি ক্ষয় কম হয়। যদিও এ নিয়ে অনেকের দ্বিমত আছে, তবুও বলা হয়ে থাকে, ‘যে প্রাণীর বিপাকক্রিয়া যত দ্রুত, সে প্রাণীর আয়ু তত কম।’
কচ্ছপ বিভিন্ন পরিবেশে নিজের শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা পরিবর্তন করতে পারে। পানি ও ডাঙ্গা দু জায়গাতেই বাস করলেও এরা ডাঙ্গায় ডিম পাড়ে। সাধারণত মেয়ে কচ্ছপ ডিমের জন্য গর্ত তৈরি করে এবং ১-৩০টি পর্যন্ত ডিম পাড়ে। সচেতন মা কচ্ছপ রাতের বেলায় ডিম পাড়া শেষে মাটি দিয়ে ডিমগুলো ঢেকে রাখে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ৬০-১২০ দিন সময় লাগে।
বিশ্বব্যাপী অবস্থা: সারা বিশ্বে ২৩ মে কচ্ছপ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। আমেরিকার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘আমেরিকান টরটয়েজ রেসকিউ’ ২০০০ সালে এ দিবসটি পালনে উদ্যোগ নেয়। সেই থেকেই সারা বিশ্বে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে কচ্ছপের অবস্থা: বাংলাদেশে প্রায় ২৫ প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে। এদের মধ্যে ১১টি প্রজাতি মানুষের খাদ্য হিসেবে প্রচলিত ও চার প্রজাতি (রুফড টার্টল, স্পটেড ফ্ল্যাপ-শেল টার্টল, পিকক সফট শেল, এশিয়াটিক সফট শেল টার্টল) রফতানি করা যায়। এরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অনেক অবদান রাখে। সামুদ্রিক কচ্ছপের মধ্যে রয়েছে অলিভ রিডলে, সবুজ কচ্ছপ, হকসবিল, লাগারহেড, ফ্ল্যাটব্যাক, লেদারব্যাক ও ক্যাম্প রিডলে। এরা উপকূল থেকে উপকূলে উদ্ভিদের বিস্তরণ ঘটায়। মাটির বিষাক্ত পদার্থ খেয়ে জলজ পরিবেশকে রক্ষা করে। একসময় বঙ্গোপসাগর, নদী-নালা, পুকুর ও বাড়ির আঙিনায় এ কচ্ছপ দেখা গেলেও পরিবেশবান্ধব এ প্রাণী আজ মারাত্মক বিলুপ্তির মুখে। দি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) সামুদ্রিক কচ্ছপ সংকটাপন্নের পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো—
মাছ ধরা: জেলেদের মাছ ধরার সময় জালে আটকা পড়ে প্রচুর কচ্ছপ মারা যায়। জালে জড়িয়ে, আবাসস্থল ধ্বংস ও খাদ্য-শৃঙ্খলে পরিবর্তনের কারণেও মারা যায়।
কচ্ছপ ও কাছিম ধরা: সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম খাওয়ার জন্য অনেকে সংগ্রহ করে। আবার কচ্ছপ ও কাছিমকে খাদ্য হিসেবেও খায়। তাছাড়া এদের থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়।
উপকূলীয় উন্নয়ন: উপকূলের উন্নয়নের নামে অনেক দেশেই কচ্ছপের আবাস ধ্বংস করা হচ্ছে। ডিম পাড়ার জন্য সংরক্ষিত স্থানে পর্যটকদের আনাগোনাও কচ্ছপ সংকটের একটি বড় কারণ। এছাড়া জাহাজ চলাচল, সমুদ্রের তলদেশের পরিবর্তনসহ নানা কারণ রয়েছে।
দূষণ: প্লাস্টিক, পরিত্যক্ত মাছ ধরার যন্ত্রপাতি, তেলবর্জ্য এবং অন্যান্য পদার্থ খেয়ে কিংবা পরিত্যক্ত জালে জড়িয়েও মারা যায়। রাসায়নিক দূষণ রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দেয়। উপকূলে আলোর ঝলকানি ডিম পাড়ায় বাধা দেয়।
জলবায়ুর পরিবর্তন: আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন এদের বাসস্থানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সাধারণত জলবায়ু পরিবর্তন, পুকুর-জলাশয়ে বিষ ও কীটনাশকের ব্যবহার, জমিতে সার প্রয়োগ, কচ্ছপের প্রয়োজনীয়তা না জানা, প্রাণী দেখামাত্রই মেরে ফেলা ইত্যাদি কারণে এগুলো সংকটাপন্ন হচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি এক তথ্যে জানিয়েছে, সাগরের তাপমাত্রা বাড়ার কারণে কমে যাচ্ছে পুরুষ কচ্ছপের সংখ্যা, অন্যদিকে বাড়ছে নারী কচ্ছপের সংখ্যা, যা কচ্ছপ বিলুপ্তিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আরো একটি হূদয়বিদারক কাজ হচ্ছে মাতা-পিতা তাদের শিশুদের খুশির জন্য পাখির বাচ্চা, খরগোশের বাচ্চা, বনবিড়ালের বাচ্চা ইত্যাদি ধরে দিচ্ছেন। কচ্ছপের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। শিশুরা কচ্ছপের মুখ বের করে আনতে লাথি গুঁতা দিচ্ছে, যার ফলাফল হচ্ছে কচ্ছপের মৃত্যু।
কচ্ছপ সংরক্ষণে করণীয়: ‘অজগরটি আসছে তেড়ে’— এ ধরনের কথায় পশুপাখির প্রতি ভীতি সৃষ্টি হয়। বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে পশুপাখির ভয় না দেখিয়ে উপকারী প্রাণীদের রক্ষাবিষয়ক পড়াশোনা করানো উচিত। বাড়ির আঙিনা, বিভিন্ন জলাশয় ও ঝোপঝাড় নিধন করার আগে দেখতে হবে কচ্ছপের আবাস আছে কিনা। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত কাছিমের ওপর নির্ভর না করে কচ্ছপ উৎপাদন করে কচ্ছপ খাওয়া ও রফতানি করা। প্রকৃতিতে সবারই কিছু না কিছু অবদান রয়েছে— এ মনোভাব সবার মাঝে গড়ে তোলা।
আইন: ১০ জুলাই, ২০১২ তারিখে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত আইন অনুসারে, আইনের ৬ ধারা মোতাবেক এ আইনের তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী শিকার বা বন্যপ্রাণী, মাংস, ট্রফি, অসম্পূর্ণ ট্রফি, বন্যপ্রাণীর অংশবিশেষ অথবা এসব হতে উত্পন্ন দ্রব্য দান, বিক্রয় বা কোনো প্রকারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আইনের ৪১ ধারা মোতাবেক আরো উল্লেখ রয়েছে, কোনো ব্যক্তি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করলে বা ওই অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা প্রদান করে থাকলে এবং ওই সহায়তা বা প্ররোচনার ফলে অপরাধটি সংঘটিত হলে, ওই সহায়তাকারী বা প্ররোচনাকারী তার সহায়তা বা প্ররোচনা দ্বারা সংঘটিত অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
শাস্তি: আইনের ৩৬ ও ৩৭ ধারায় বাঘ, হাতি, চিতাবাঘ ইত্যাদি শিকার বা হত্যার অপরাধ করলে আইনের ৩৬ ধারায় দণ্ড সর্বনিম্ন দুই বছর, সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন ১ লাখ, সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। সংরক্ষিত উদ্ভিদ-সংক্রান্ত ৬ নং ধারা লঙ্ঘন করলে ৩৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি এক বছরের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পুনরায় একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে।
কচ্ছপ যে ডিম পাড়ে, তা থেকে প্রায় সব ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলেও তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক সদস্যই পরিণত অবস্থায় রূপান্তর হতে পারে। এর পেছনে প্রধান বিষয়, ওইসব বাচ্চা কাছিমগুলোর শারীরিক অক্ষমতা নয়, বরং উচ্চ অর্থ লোভের কারণে অনৈতিকভাবে খোলস বিক্রির বাণিজ্য, মাংসের চাহিদা থাকার কারণে নানা দেশে রফতানি, সাগরের মাঝে জাল দিয়ে মাছ চাষ, তৈলাক্ত পানি ও বাসস্থান ধ্বংসই এর মূল কারণ। কচ্ছপকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সরকারের পাশাপাশি সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে এবং কচ্ছপ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
কৃপ্র/এম ইসলাম