এস এম মুকুল।।
হাওরাঞ্চল বাংলাদেশের অতি প্রাকৃতিক জোন। যদিও বা অতি প্রাকৃতিক জোন হিসেবে আজও হাওরকে মূল্যায়ন করা হয়নি। শত বছরের হাওর বাংলার কালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে এই হাওরবাসীরা বংশপরম্পরায় প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে আছেন। অসময়ে বন্যা, অতি খরা, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, কালবৈশাখী ঝড় আর ৬ মাস অথৈ পানির বিনাসী আফালের (ঢেউ) তা-বলীলার সঙ্গে হাওরবাসীর যুদ্ধ যেন নিয়তির লিখন। বছরের ৬ মাস পানিতে ভাসমান আর ৬ মাস শুকনা থাকার প্রাকৃতিক নিয়মের ছকে বাঁধা হাওরবাসীর জীবনচক্র।
প্রকৃতির বৈরিতায় একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ গ্রাস করে নিয়ে যায় হাওরের সোনার ফসল। কখনো পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টিতে ফসল হারায় হাওরের মানুষ। কখনোবা কালবৈশাখী আর শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এসব প্রাকৃতিক বৈরিতার সঙ্গে নতুন করে যোগ হলো বজ্রপাত আতঙ্ক। অতি প্রাকৃতিক এলাকা হিসেবে হাওরবাসীর পিছন থেকে দুর্যোগ হানা যেন ছাড়ছেই না।
প্রকৃতির মেজাজ-মর্জির ওপর নির্ভর করেই জীবনযাপন করতে হয় হাওরবাসীকে। ধান আর মাছে সমৃদ্ধ হাওর এলাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে গতিময় করতে বিশাল ভূমিকা রাখলেও সে তুলনায় হাওরাঞ্চলের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের দৃষ্টি অনেক কম।
গতবছর অকালবন্যায় বোরো ফসল, হাঁস, গবাদিপশু, মাছ সব হারিয়ে প্রায় নিঃস্ব কৃষকরা ঋণদারি করে, শরীরের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে আবারও ফলিয়েছেন সোনার ফসল। এ জন্য হাওরের কৃষকদের অভিবাদন জানাতেই হয়।
গত বছরের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পর এবার বোরো ধানের ব্যাপক উৎপাদন হলেও শেষদিকে প্রকৃতির বৈরিতা যেন আর ছাড় দিল না হাওরবাসীকে। বৃষ্টি, ঝড়, শিলাবৃষ্টি আর বজ্রপাতের কারণে অনেকের জীবন গেছে, জমি থেকে কেটে আনা ধান মাড়াই আর শুকানোর বিলম্বের কারণে নষ্ট হয়ে গেছে ধানের রং। একারণে হাওরের কৃষকরা পাচ্ছেন না ধানের নায্য দাম। অন্যদিকে খড়কুটা পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গবাদিপশুর খাদ্য সঙ্কটের দুশ্চিন্ত্মায় দিন কাটছে হাওরবাসীর।
এবার ফলন খুব ভালো হলেও ফসল কাটার মৌসুমের শেষ সময়টা তাদের অনুকূলে ছিল না। গোলা ভরে ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন থাকলেও বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবেশের বৈরী প্রভাব দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। যে সময়ে প্রয়োজন ছিল কাঠফাটা রোদের এমন সময় ঘন ঘন বৃষ্টি কৃষকের দুশ্চিন্ত্মার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একদিকে প্রকৃতির বৈরিতায় শুকাতে পারছেন না খলা (ধান কেটে মাড়াই ও শুকানো জায়গা) ভরা ধান। অন্যদিকে এখনো যে পরিমাণ জমির ধান কাটা বাকি সে তুলনায় শ্রমিকের তীব্র সঙ্কট। আবার বজ্রপাতে মৃতু্যর আতঙ্কে শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ধান কাটতেও যেতে চায় না। কেননা গত বিশ দিনে হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণ দিয়েছেন অনেক কৃষক ও কৃষি শ্রমিক। এসব কারণে হাওরের ফলন ভালো হলেও শ্রমিক সঙ্কট ও বজ্রপাতের কারণে ধান কাটায় দেখা দিয়েছে স্থবিরতা।
সুনামগঞ্জের জয়শ্রী এলাকার শিক্ষক আজহারম্নল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- হাওরে ধান কাটার শুরম্নতে প্রথমে দেখা দেয় শ্রমিকের অভাব। তারপর বৃষ্টির কারণে সেই ধান শুকিয়ে ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষক। ধানের রং নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে নায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক।
বৃষ্টি-বাদলের কারণে খড় শুকাতে না পারায় গো-খাদ্যেরও সঙ্কট দেখা দেবে বলে তিনি জানিয়েছেন। এ নিয়ে মহাদুশ্চিন্ত্মায় রয়েছেন হাওরের কৃষকরা। এদিকে জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বজ্রপাতে হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে।
তাহিরপুর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রফিকুল হক চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর অকাল বন্যায় হাওরের ফসল তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয় কৃষকের। এবারের ফসল খুবই ভালো হয়েছে। তবে শ্রমিক সঙ্কট আর বৃষ্টির কারণে কৃষকরা এখন ফসল গোলায় উঠাতে পারছেন না।
নেত্রকোনা মোহনগঞ্জের সাংবাদিক আবুল কাশেম আজাদ জানান- ‘হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, আশঙ্কাজনক হারে বজ্রপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওরের কৃষকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আকাশে কালো মেঘ দেখলেই আতঙ্কে কাজ ফেলে নিরাপদে আশ্রয় নিতে ছুটে যান কৃষক-কৃষাণীরা। তিনি আরও জানান, হাওরাঞ্চলে খবর নিয়ে জানা গেছে বজ্রপাতে পুরম্নষ কৃষি শ্রমিকরা হাওরে ধান কাটতে গিয়ে এবং নারীরা খলায় ধান মাড়াইয়ের সময় প্রাণ হারাচ্ছেন। বজ্রপাতের এমন ভয়াবহতায় কৃষক ও শ্রমিকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
‘মাছ আর ধান হাওরের প্রাণ’- হাওরাঞ্চলের মানুষ একসময় গর্ব করে বলতো। বর্ষার ছয় মাস হাওরের অথৈ পানিতে বেড়ে ওঠে দেশীয় প্রজাতির মাছ। আবার পানি যখন শুকিয়ে যায় তখন বাহারি প্রজাতির দেশীয় মাছ সব গিয়ে জমা হয় হাওরের নিম্নাঞ্চল জলমহালে।
হাওরাঞ্চলের জলরাশিতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নানা জাতের মাছ যেমন- কৈ, সরপুঁটি, পুঁটি, তিতপুঁটি, কাতলা, মাগুর, খৈলসা, বাঁশপাতা, আইড়, টেংরা, বাইম, চিতল, ভেদা, পাবদা, গজার, শোল, মহাশোল, চাপিলা, কাকিলা, বোয়াল, মৃগেল, রম্নই, কালবাউশ প্রভৃতি। বিভিন্ন তথ্য বিশেস্নষণে জানা গেছে, বাংলাদেশে ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে হাওরগুলোতে ১৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত।
তবে গত প্রায় এক দশকে বাঘাড়, তিলা শোল, ঘাউড়া, বাচা, ঘোড়া মুইখ্যা, পাঙ্গাশ, রিটা, মহাশোল, বামোশ, রানি, গজার, কাশ খাউড়া, কালাবাটা, ঘইন্যা, শাল বাইম, গুইজ্জা, চিতল, কানি পাবদা, গুজি আইড়, হলুদ-সোনালি দেহের নয়ন জুড়ানো রানি মাছসহ প্রায় ৬২ প্রজাতি মাছ বিলুপ্তির পথে। হাওর শুধু মাছ আর ধান নয় পাখির জন্য অভয়ারণ্য এলাকা। শুকনো মৌসুমে বিশেষত শীতকালে দেশের বিরল প্রজাতির বহু পাখির দেখা মিলবে হাওরের বদ্ধ জলাশয়ে। হাওরের হিজল বাগে বসে পাখিদের মিলনমেলা।
আশার খবর হচ্ছে- বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও হাওর এতদিন ছিল দৃষ্টির আড়ালে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর হাওরের সম্ভাবনা নিয়ে গ্রহণ করা হয় হাওর উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা। প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্ত্মিক আগ্রহে মহাপরিকল্পনা বাস্ত্মবায়নে কার্যক্রম শুরম্ন হয়েছে। আমরা জানি, শেখ হাসিনার আগ্রহে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা এলাকায় এখন ফসল ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছায় হাওরবাসীর অকালবন্যায় ফসলহানির অনিশ্চয়তাও ঘোচানো সম্ভব হবে। হাওর নিয়ে এখন একটি আশাবাদের জায়গা তৈরি হয়েছে। হাওরবাসীর প্রত্যাশা সমন্বিত ও পরিকল্পিত উপায়ে মহাপরিকল্পনা বাস্ত্মবায়িত হলে ১০ বছরে পাল্টে যাবে হাওরের অর্থনৈতিক চেহারা। কম সময়ে উচ্চফলনশীল ধান ও হাওরের উপযোগী রবিশস্য উৎপাদন এনে দিতে পারে নতুন দিগন্ত্ম। হাওরাঞ্চলে একটিমাত্র ফসল বোরো ধান।
দুঃখ কিংবা গর্ব যাই হোক বলা হয়ে থাকে- ‘এক ফসলি ধান; হাওরবাসীর প্রাণ’। বছরে একটিমাত্র ফসল হলেও বিরল বিচিত্র দেশি জাতের অনেক ধান এখনো হাওরাঞ্চলে উৎপাদিত হয়। দেশের খাদ্যচাহিদা পূরণে ধান ও আমিষ চাহিদা পূরণে মাছের অন্যতম উৎস হাওর। কৃষিবিদদের মতে, দেশে আবাদযোগ্য পতিত জমিসহ উপকূল ও হাওরাঞ্চলের জলাবদ্ধ এক ফসলি জমিকে দুই বা তিন ফসলি জমিতে পরিণত করতে পারলে বছরে ৫০ লাখ টন বাড়তি খাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব। অনেকের ধারণা, হাওরের সোনার ফসল প্রতিবছর ঠিকমতো ঘরে তুলতে পারলে ১০ বছরে পাল্টে যাবে হাওরাঞ্চলের অর্থনৈতিক চেহারা।
লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশেস্নষক/ কৃপ্র/এম ইসলাম