‘প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য পশু কোরবানি ভূমিকা রাখে’
কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ।।
দেশের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গবাদিপশু কোরবানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবছর ঈদুল আজহার দিন প্রায় এক কোটি গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, উট ইত্যাদি গবাদি পশু জবাই করা হয়। এগুলোর গোসত, চামড়া, রক্ত, হাড়, মলমূত্র ইত্যাদি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতি বছর ঈদুল আজহায় প্রচুর গবাদিপশু কোরবানি হলেও পশুর সংখ্যা না কমে বাড়ে। যেমন ২০০১-০২ অর্থ বছরে গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ৪.১৬ কোটি ও মাংস উৎপাদন ছিল ৭.৮ লক্ষ মে. টন। ২০০৯-১০ অর্থ বছরের বেড়ে ৫.০৬ কোটি হয়েছে এবং মাংস উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ১২.৬ লক্ষ মে. টন। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই গরুর তড়কা রোগ দেখা যাচ্ছে। গ্রোথ হরমোন দিয়ে বড় করা গরুর গোসত স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য কোরবানির গবাদিপশু ক্রয় বা নির্বাচন থেকে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা পর্যন্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য পশু কোরবানি ভূমিকা রাখে।
গবাদিপশু ক্রয়
কমপক্ষে গরু ও মহিষ দুই বছর, ছাগল ও ভেড়া এক বছর ও উটের পাঁচবছর বয়সে কোরবানি দেয়া যায়। এগুলোর নিচের মাড়িতে সামনে কমপক্ষে দুইটি বড় দাঁত গজালে বুঝতে হবে কম পক্ষে দুই বছর হয়েছে। গবাদিপশু মোটা, তাজা, সুস্থ, সবল হতে হবে। কান, শিং ও লেজের দুই তৃতীয়াংশের বেশি থাকতে হবে। তড়কা বা অ্যানথ্রাক্স রোগ আছে কিনা বোঝার লক্ষণ হচ্ছেÑ দেহের তাপমাত্রা বেশি, দেহ কাঁপে, দাঁড়াতে পারে না, লোম খাড়া, শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত ও গভীর হয়। ক্ষুরা রোগের লক্ষণ হচ্ছেÑ জিহবা ও ক্ষুরের মাঝে ক্ষত থাকবে। পশু খুড়িয়ে হাঁটবে। অন্যান্য রোগ বোঝার জন্য পায়ুপথ, খাদ্য গ্রহণ ও নাক-মুখ দিয়ে তরল পদার্থ বের হয় কিনা দেখতে হবে। বেশি মোটা, নাদুস নুদুস পশু হরমোন দিয়ে বৃদ্ধি করা হয়। পা উঁচু, কুজঁ নেই, দেহ খুব বড় গরু বিদেশি জাতের। দেহ লম্বা ও পেট ছোট গরুতে গোসত বেশি হয়। গোসত কতটুকু হবে মাপার জন্য সূত্র হচ্ছেÑ গরুর ওজন (কেজি) = ০.০০০১ দেহের দৈর্ঘ্য সেমি {বুকের বেড় (সেমি)}২। গরুর কাঁধ থেকে লেজের গোড়া পর্যন্ত দেহের দৈর্ঘ্য। বুক বরাবর পরিধি ফিতা দিয়ে মেপে বুকের বেড় পরিমাপ করা যায়। এই মান সূত্রে বসিয়ে হিসেব করে গরুর ওজন নির্ণয় করা যায়।
গবাদিপশু জবাই
জবাই করার আগে পশুকে ভালোভাবে গোসল করাতে হবে। কোরবানির ২/৩ দিন আগে থেকে প্রচুর পানি ও তরল খাদ্য খাওয়াতে হবে। এতে চামড়া ছাড়ানো সহজ হবে। পশু জবাইয়ের ১২ ঘন্টা আগে দানাদার ও শক্ত খাবার দেয়া যাবে না। ছুরি খুব ধারালো হতে হবে। জবাই করার স্থান সমতল হতে হবে। মাটির গর্তের ওপর মাথা রাখতে হবে। পশুর চার পা বেঁধে বা তিন গিট বা ক্রিসক্রস পদ্ধতিতে দড়ি দিয়ে বেঁধে আস্তে করে শুইয়ে দিতে হবে। মুখ, গলা ও বাঁধা পা পশ্চিম দিকে, মাথা দক্ষিণ দেক এবং পিছনের অংশ উত্তর দিকে রাখতে হবে। দোয়া পড়ে ও তিনবার আলাহ আকবার বলে খুব ধারালো ছুরি দিয়ে চোয়ালের শেষ প্রান্তে এবং গলার প্রথম অংশে জোরে কেটে দিতে হবে। গলনালী কাটা হলেই বুঝতে হবে জবাই হয়েছে। জবাইয়ের পর সমস্ত রক্ত বের হতে দিতে হবে।
চামড়া সংগ্রহ
পশুর নিস্তেজ, ঠান্ডা ও রক্ত প্রবাহ বন্ধ হওয়ার পর চামড়া ছাড়ানোর কাজ শুরু করতে হবে। চামড়া ছাড়ানো ক্রটি হলে দাম কম হয়। এজন্য নিয়মমত চামড়া ছাড়ানো উচিত। পশু ছোট হলেÑ গাছের ডালে ঝুলিয়ে ধারালো চাকু দিয়ে চামড়া ছাড়ানো যায়। পশু বড় হলে মাটিতে চিৎকরে শুইয়ে নিতে হবে। চাকু দিয়ে জবাই করার স্থান থেকে গলা, বুক ও পেটের ওপর দিয়ে সোজা করে চামড়া কেটে দিতে হবে। চামড়া ছাড়ানোর সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেনÑ চামড়া না কাটে, চামড়ায় চর্বি ও মাংস লেগে না থাকে। চামড়ায় রক্ত, গোবর বা কাদা পানি না লাগে। ছুড়ি দিয়ে চামড়া গলার অর্ধেক, সামনের পা, বুক, কাঁধ ও পেটের চামড়া ছাড়াবেন। পিছনের পা ছাড়িয়ে পিঠ পর্যন্ত নিবেন। বুক ও পেটের চামড়া ছাড়ানোর সময় চর্বি ও মাংস চামড়ার সাথে লেগে থাকে বলে সাবধানে চামড়া ছাড়াতে হবে।
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ
চামড়া দেশের অর্থনৈতিক ও রপ্তানি ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। ইতিপূর্বে চামড়ায় ভেজাল দিয়ে চামড়া রপ্তানি করায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়ার কদর কমেছে। এজন্য চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ গুরুত্ব সহকারে করা উচিত। পশু থেকে চামড়া ছাড়িয়ে পরিস্কার শুকনো জায়গায় রেখে চামড়ার গায়ে লেগে থাকা চর্বি ও মাংস, পর্দা, রক্ত ইত্যাদি পরিস্কার করতে হবে। চামড়ার ভেতরের পিঠ ওপরের দিকে রেখে লবণ ছড়িয়ে হাত দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। প্রথমবার লবণ চুষে নিলে আরেকবার লবণ দিতে হবে। প্রতিটি গরুর চামড়ার জন্য ৪-৫ কেজি এবং ছাগলের চামড়ার জন্য ১ কেজি লবণ দিতে হয়। চামড়া ছাড়ানো ৫/৬ ঘন্টার মধ্যে বিক্রি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
উপজাত সংগ্রহ
গবাদিপশুর রক্ত, চর্বি, নাড়িভূঁড়ি, শিং, পশম, ক্ষুর, লেজ, হাড়, দাঁত ইত্যাদি উপজাতগুলো দিয়ে মানুষের ও পশুপাখির জন্য অনেক কিছু তৈরি করা যায়। যেমনÑ ১) রক্ত ও হাড় দিয়ে পশুপাখির খাদ্য তৈরি করা যায়। ২) নাড়িভূঁড়ি দিয়ে মাছ ও মুরগির খাদ্য তৈরি করা যায়। মানুষের প্রিয় খাদ্য। ৩) পশম দিয়ে কম্বল ও পোশাক তৈরি করা হয়। ৪) পশুর শিং দিয়ে শোপিচ, বোতাম ও চিরুনি তৈরি করা হয়। ৫) চর্বি দিয়ে সাবান ও কসমেটিক্স তৈরি করা হয়। ৬) গোবর, মূত্র, বিছানাপত্র, গোয়াল ঘরের আবর্জনা দিয়ে জৈব সার তৈরি করা যায়।
(বিঃ দ্রঃ) কোরবানির কাজ শেষ হলে নিজ দায়িত্বে প্রত্যেকেই জায়গা পরিস্কার করা উচিত। জীবাণুনাশক ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত করলে রোগজীবাণু ছড়াবে না।
গরুমোটাতাজাকরণ
ঈদুল আজহার ৩/৪ মাস আগে গরু মোটাতাজা করার কাজ শুরু করলে লাভবান হওয়া যায়। গরু মোটাতাজা করার জন্য গরু নির্বাচন, গরুর বাসস্থান নির্মাণ, কৃমি মুক্তকরণ, গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও খাদ্য খাওয়াতে হয়।
গরু নির্বাচন ঃ দেড়-দু’বছর বয়সের সংকর জাতের ষাড় বাছুর নির্বাচন করা। ভালো জাতের গরু, ঘাড় খাটো, হাড়ের জোড়াগুলো মোটা প্রকৃতির, বুক চওড়া ও পাঁজরের হাড় চ্যাপ্টা, কোমরের দু’পাশ প্রশস্ত ও পুরু, কপাল প্রশস্ত, উচুঁ ও লম্বা, চামড়া ঢিলা, স্বাস্থ্যহীন ও রোগমুক্ত গরু নির্বাচন করতে হয়।
বাসস্থান নির্মাণ ঃ প্রতিটি গরুর জন্য দৈর্ঘ্য ৮ ফুট, প্রস্থ ৬ ফুট ও উচ্চতা ৮ ফুট জায়গা প্রয়োজন। ঘরের ভেতর আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা। ঘরের মেঝে একদিকে ঢালু রাখা। ঘরের ভেতর খাদ্য ও পানি পাত্র থাকবে।
কৃমিমুক্তকরণ ঃ গরু ক্রয় করার পরেই গরুর পেট থেকে কৃমি মুক্ত করতে হবে। অন্যথায় গরুর খাদ্যের বিরাট অংশ খেয়ে গরুকে পুষ্টিহীন ও রক্ত শূন্য করে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী কৃমির ট্যাবলেট খাওয়াতে হবে।
স্বাস্থ্য পরীক্ষা ঃ গরু রোগাক্রান্ত কিনা ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। গরুর রক্ত, মল, জিহবা, পায়ের ক্ষুর, নাড়ীর স্পন্দন ইত্যাদি পরীক্ষা করা হয়। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতে হবে। বিভিন্ন রোগের টিকা দিতে হবে।
সুষম খাদ্য খাওয়ানো ঃ সঠিক পরিমাণে পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ালে ষাড় বাছুরের ওজন প্রতিদিন প্রায় এক কেজি পর্যন্ত বাড়ে। ১০০-১৫০ কেজি ওজনের একটি ষাড় বাছুরকে প্রতিদিন ইউরিয়া প্রক্রিয়াজাত খড় ৩-৪ কেজি, সবুজ কাঁচা ঘাস ১০-১২ কেজি, চালের কুঁড়া ১ কেজি, গমের ভুসি ১.২৫ কেজি, তিলের খৈল ৪০০ গ্রাম, হাড়ের গুঁড়া ৫০ গ্রাম, লবণ ৫০ গ্রাম ও ঝোলাগুড় ২৫০ গ্রাম খাওয়াতে হয়। পানি পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়াতে হবে। ইউরিয়া ও খড় প্রক্রিয়াজাত করার ৭ দিন পর খাওয়াতে হবে। অন্যথায় বিষাক্ততা দেখা দিবে। এক বছরের কম বয়সের বাছুর কে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না। অন্যকোনভাবে ইউরিয়া খাওয়ানো যাবে না।
স্বাস্থ্য সর্তকতা
গরু মোটাতাজা করার জন্য গ্রোথ হরমোনের ইনজেকশন দেয়া হয়। এতে গরুর দেহের কোষ খুব দ্রুত বড় ও বৃদ্ধি হয়। ফলে গরু খুব তাড়াতাড়ি মোটা হয়। কিন্তু ওজন খুব বাড়ে না। পশু দুর্বল হয়। এই গরুর গোসতে গ্রোথ হরমোনের রাসায়নিক পদার্থ থাকে। এই রাসায়নিক পদার্থ মানবদেহের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে চিকিৎসকরা বলেন। অপরদিকে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জন্য গরুকে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়। এই এন্টিবায়োটিকের রাসায়নিক পদার্থও জীবাণু প্রতিরোধের জন্য দীর্ঘদিন মাংসে থাকে। এই রাসায়নিক পদার্থ মাংস ভক্ষণের সাথে মানুষের পেটে যায়। গ্রোথ হরমোন ও এন্টিবায়োটিক উভয়ের রাসায়নিক পদার্থ রান্নার তাপেও নষ্ট হয়না বলে মানবদেহে ফুসফুস, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন স্থানের কোষ নষ্ট করে ক্যান্সারের সৃষ্টি করে।
মার্কিন যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডস এর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সিলেক্ট কমিটির রির্পোটে বলা হয়, এন্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা পশুর গোসত ও দুধ মানুষ খেলে মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয় এবং স্যালমনেলাসহ বিভিন্ন অনুজীবঘটিত রোগ সৃষ্টি হতে পারে যা নিরাময় হয় না। গ্রোথ হরমোন দিয়ে মোটাতাজা গরুর দেহের মাসংপেশী ফোলা, নাদুস-নুদুস, দেহ দুর্বল হয় ও বেশি স্বাস্থ্যবান হয়। গরুর গোসতে ইন্টার সেলুলার ফ্যাট থাকায় মানবদেহে কোলেস্টেরল ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
গবাদি পশু কোরবানি আমাদের জাতীয় ও ধর্মীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একে ধর্মীয় অনুভূতির সাথে সাথে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা ভাবতে হবে। কোরবানির পরে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে পরিবেশ ভালো রাখা সকলের দায়িত্ব।
লেখক : কৃষি প্রাবন্ধিক, সম্পাদক , কৃষি প্রতিক্ষণ’