ড. মো. হুমায়ুন কবীর।।
নীল চাষ, নীল কর ইত্যাদি একসময় একটি আতঙ্কের বিষয় ছিল বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। ব্রিটিশরা একসময় বাঙালি কৃষকদের নীল চাষ করাতে বাধ্য করত। ইতিহাস থেকে জানা যায় সপ্তদশ শতক থেকে এতদাঞ্চলে নীল চাষের গোড়াপত্তন হয়। কারণ এখানকার মাটি, আবহাওয়া ও জলবায়ু নীল চাষের জন্য খুবই উপযোগী ছিল। তখন ব্রিটিশ শাসকচক্র বাংলার কৃষকদের দিয়ে নীল চাষ করিয়ে নিত। কিন্তু এর লাভের বেশিরভাগ নিয়ে যেত বেনিয়ারা। তখন কৃষকগণকে লাভের বদলে দিনের পর লোকসান গুণতে হতো।
যখন দিনের পর দিন লাভের পরিবর্তে লোকসান গুণতে হতো, সেজন্য বাংলার কৃষককুল হতাশা থেকে নীল চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা আর তখন নীল চাষ করতে চায়নি। সেজন্য তাদের অমানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হতো। এভাবে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ চলতে চলতে অষ্টাদশ শতকের দিকে এসে আস্তে আস্তে বাংলার কৃষকগণ বিদ্রোহ করতে শুরু করেছিল। নীল করদের বিরুদ্ধে এভাবে বিদ্রোহের মাধ্যমেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। তাইতো সেইসব ঘটনাকে উপজীব্য করে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রচনা করেছিলে দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’।
নীল আসলে কী? দীর্ঘদিনের ব্যবধানে এখন হয়তো নীল সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু ভুলে গেছি। নীল হলো আসলে একটি কৃষি ফসল। ই্ংরেজিতে একে বলে ইন্ডিগো (ওহফরমড়) এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো ওহফরমড়ভবৎধ ঃরহপঃড়ৎরধ. নীলের চাষাবাদ পদ্ধতি খুব সহজ। বাংলাদেশের আবহাওয়া নীল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। যেকোন ধরনের উঁচু মাটিতেই নীলের আবাদ করা সম্ভব। তবে বেলে মাটি যেখানে অন্য তেমন কোন ফসল হয়না সেসব স্থানেও নীল চাষ করা সম্ভব। তাছাড়া নীল চাষের জন্য জমি প্রস্তুত করা খুবই সহজ। আবার দেখা যায় ক্ষেতের আইলে, পুকুরের পাড়ে, নদীর ধারে, রাস্তা-ঘাট ও মাঠের পাশেও বিনা চাষে নীল আবাদ করা যায়।
নীল গাছের গড় উচ্চতা দেড় থেকে দুই মিটার। এটি লিগুমিনাস প্রজাতির ফসল। দেখতে অনেকটা পাট গাছ কিংবা মেহেদি গাছের মতো। তবে নীল গাছে প্রচুর পরিমাণে নীলাভ-সবুজ ব্রাঞ্চিং বা ডাল-পালা থাকে। আর এসব ডাল-পালাতে অনেক পাতা উৎপন্ন হয়। এসব পাতার নির্যাস থেকেই আসলে প্রাকৃতিক রং নীল উৎপন্ন হয়। গাছের পাতা থেকে নির্যাস হিসেবে নীল সংগ্রহের পর যেসব পাতা থাকে সেগুলোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেন পাওয়া যায়। সেসব পাতা দিয়ে তখন সার তৈরী করা হয় যা দ্বারা ইউরিয়া সারের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে লাভবান হওয়া যায়।
বাংলাদেশের আবহাওয়ায় মার্চ মাসে নীল রোপণ করা হয়। রোপণের তিনমাস পর থেকে নীল গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে নীল আহরণ করা যায়। জুলাই থেকে সেপ্টম্বর মাস অবধি নীল গাছে ফুল ফল হয়। সেখান থেকে ফুল এবং ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে সেই বীজ থেকে চারা এবং সেই চারা থেকেই নীল গাছ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই নীল চাষের জন্য উপযোগী, তবে একসময় সারা বাংলায় নীল চাষ হলেও এখন আর বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে নীল চাষ হচ্ছে না। কিন্তু প্রায় একযুগ ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোন কোন স্থানে ক্ষুদ্র পরিসরে নীল আবাদ হচ্ছে। সেসব স্থানের মধ্যে যশোর এবং রংপুর অন্যতম।
২০০৬ সাল থেকে রংপুরের কয়েকটি ইউনিয়নে নীল আবাদ হয়ে আসছে যার সফলতার কারণে তা এখন অনেকটাই সম্প্রসারিত হচ্ছে। লাভবান হচ্ছেন সেসব এলাকার কৃষক। আগেই বলেছি লিগুমিনাস জাতীয় একটি ফসল হওয়ার কারণে এর আবাদের ফলে জমিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কিছু নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে থাকে। এতে সেসব জমিতে ইউরিয়া সারের চাহিদা কম লাগে। তাছাড়া বাড়তি ডাল-পালা লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ নীল আবাদে শুধু যে নীলই পাওয়া যায় তাই নয়। এর থেকে উপজাত হিসেবে নাইট্রোজেন, লাকড়ি, বীজ ইত্যাদি পাওয়া যায় যা থেকেও কৃষক সমানভাবে লাভবান হয়ে থাকে।
একসময় নীল নিয়ে কেন এত আগ্রহ ছিল তা আমরা একটু আলোচনা করলেই বুঝা যাবে। কারণ প্রাকৃতিক রঙ হিসেবে নীলের জৃুড়ি ছিলনা। তাছাড়া এ অঞ্চলের নীল থেকে যে মানসম্পন্ন নীল পাওয়া যেত তা আর কোথাও হতো না। আর বর্তমানে যেমন কৃত্রিম সবকিছু পরিহার করে মানুষ আবার সেই প্রাকৃতিক জিনিসপত্রের দিকে ঝুঁকছে। সেজন্য আবারো বাংলাদেশের নীলের চাহিদা দেখা দিয়েছে। তাই এর আবাদও আবার সম্প্রসারণের দিকে এগুচ্ছে। কারণ আমরা দেখছি বিভিন্ন কৃত্রিম তন্তু বাদ দিয়ে যেমন পাট ও পাটজাত তন্তুর কদর বাড়ছে। ঠিক তেমনি কৃত্রিম বিভিন্ন রঙের বদলে প্রাকৃতিক নীল রঙের জন্য নীল চাষের গুরুত্ব বাড়ছে।
বাংলাদেশে রংপুরের কয়েকটি ইউনিয়নে কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনের সহায়তায় আবারো নীল চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে। সেখানে প্রতিবছর কমপক্ষে একহাজার কেজি নীল উৎপাদিত হচ্ছে। তাতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানিও করছে সেসব নীল। গতবছর (২০১৮) নীল রপ্তানি করে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার (৫০ লাখ টাকা) বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনটি হলে কৃষিতে রপ্তানির তালিকায় আরেকটি সম্ভবনাময় অপ্রচলিত কৃষিপণ্য যুক্ত হলো যার মাধ্যমে আগামীতে অরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
আমাদের দেশের উৎপাদিত ভালো মানের নীলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের আরো অনেক দেশে। একমাত্র ভারতেই প্রতিবছর নীলের চাহিদা হলো ২৫০ মেট্রিক টন। কাপড়ের মধ্যে রঙ লাগাতেই এসব নীল বেশি ব্যবহার করা হয়। কারণ হিসেবে জানা গেছে, কৃত্রিম রঙ ব্যবহারের ফলে নাকি মানুষের গায়ে ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের সুষ্টি হয়ে থাকে। তাই প্রাকৃতিক রঙের দিকেই ঝুঁকছে আধুনিক মানুষ। তাছাড়া নীল চাষের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ এক সময় উত্তরবঙ্গে যে মঙ্গা নামক অভাব জেঁকে বসত এখন তা আর নেই। সেসবের একটি অন্যতম কারণ হলো জুলাই আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তাদের হাতে কাজ সৃষ্টি হওয়া। সেসব কাজের অনেকটাই সৃষ্টি করেছে নীল চাষ।
জানা গেছে, রংপুর জেলার সদর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে এখন নীলের আবাদ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এগুলো হলো- রাজেন্দ্রপুর, খালেয়া গঞ্জিপুর, মমিনপুর, চন্দনপাঠ ও হরিদেবপুর। এছাড়া গঙ্গাচড়া উপজেলায়ও কিছু পরিমাণে নীলের আবাদ হয়। ২২ থেকে ২৫ ইঞ্চি পরিমাণ পর্যন্ত ডাল কেটে সংগৃহীত ও উৎপাদিত প্রতিকেজি নীল গাছের পাতা ৩০০ টাকা দরে এবং উৎপাদিত বীজের প্রতিকেজি ১০০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারে কৃষকগণ। এসব নীল আবাদ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের পাশাপাশি সরকারি সংস্থা হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের স্থানীয় মাঠকর্মীবৃন্দ পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে চলেছেন। এটি একটি পরিবেশসম্মত কৃষি ব্যবস্থা। কারণ আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি তামাক একটি কৃষিপণ্য কিংবা কৃষি ফসল হলেও সেটি পরিবেশের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। কিন্তু নীল সম্পূর্ণরূপে একটি পরিবেশসম্মত কৃষি ফসল।
যেহেতু এখন নীল ইউরোপসহ বহির্বিশে^র অনেক দেশে প্রচুর চাহিদার একটি পণ্য। কাজেই এখন তা দিয়ে একটি মধুর প্রতিশোধও নেওয়ার সুযোগ সুষ্টি হয়েছে। কারণ একসময় বাংলার কৃষককে শোষণ করে অর্থ পাচার করত ইংলিশ নীল করেরা। কিন্তু বৈধভাবেই নীল উৎপাদন করে সেসব দেশে রপ্তানি করে সেখান থেকে নীলের বিনিময়ে বৈদিশিক মুদ্রা অর্জনই হলো মধুর প্রতিশোধ। কারণ তাদের কাছে এখন যেমন তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে পরিচিত করেছে। কাজেই একসময় অত্যাচারের মাধ্যমে পাচার করার সম্পদ নীল তাদেরকেই আমাদের দেশ থেকে চরমমূল্যে কিনে নিতে হবে- তাতো সত্যিই একটি মধুর প্রতিশোধ তাতে কোন সন্দেহ নেই। এভাবেই প্রতিক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তেমনটিই প্রত্যাশা।
লেখক: কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়