আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ।।
শীতপ্রধান অঞ্চলের জনপ্রিয় সবজি ব্রাসেলস স্প্রাউট। আমাদের দেশে একেবারে নতুন। এটি এবারই প্রথমবারের মতো চাষ হলো রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) গবেষণা মাঠে। উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসনাত সোলায়মান ইংল্যান্ড থেকে এর বীজ এনে দেখতে চাইলেন, এ দেশের আবহাওয়ায় এটির চাষ আদৌ সম্ভব কিনা! যা সত্যি সবাইকে অবাক করে দিয়ে এ দেশের মাটি ও বাতাসে উৎপাদিত হলো ব্রাসেলস স্প্রাউট। এটি গুনে-স্বাদে অনন্য এক পুষ্টিকর সবজি। একটি নতুন সম্ভাবনার উঁকিঝুঁকি দেখতে গবেষণারত শিক্ষার্থী নওরিন অন্তরা আর তার গবেষণা সুপারভাইজার প্রফেসর ড. আবুল হাসনাত মো. সোলায়মানকে সঙ্গে নিয়ে ব্রাসেলস স্প্রাউটের মাঠে গেলাম। দেখলাম, জানলাম, শিখলাম অনেক কিছু। বুঝলাম-সম্ভাবনায় ভরপুর এ সবজির বাণিজ্যিক চাষে আরও কিছু গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
ব্রাসেলস স্প্রাউট কপিজাতীয় সবজি। অনেকটা বাঁধাকপির মতো। প্রতিটি পাতার গোড়ায় বাঁধাকপির মতো একটি করে ছোট কুঁড়ি হয়। এ কুঁড়ি বা বাডটি ব্রাসেলস স্প্রাউট, যা খাওয়া হয়। এমনিতেই কপিজাতীয় সবজিগুলোয় ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান বেশি থাকে। ক্রুসেফেরি পরিবারের সবজিগুলোর মধ্যে ব্রাসেলস স্প্রাউটে ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান- গস্নুকোসিনোলেটসের পরিমাণ সর্বাধিক। এ ছাড়া অন্যান্য কপিজাতীয় সবজির তুলনায় এতে এন্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, এ, কে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। পুষ্টিগুণ ও স্বাদ বিবেচনায় তাই এই সবজিটি উন্নত বিশ্বে সবার প্রছন্দ।
এটি শীতকালীন ফসল। তাই শীতকাল যত দীর্ঘ হবে, এ ফসলের ফলন তত বেশি হয়। সে বিবেচনায় দেশের উত্তরাঞ্চল বেশ উপযোগী হতে পারে। তাই আগাম চাষে ফলন অনেক বেশি হবে। তাপমাত্রা যত বাড়বে ততই বাড বা স্প্রাউটের আকার ছোট হয় এবং বাডগুলো তুলনামূলক শক্ত হয়।
ব্রাসেলস স্প্রাউটের চাষাবাদ পদ্ধতি অনেকটা বাঁধাকপির মতো। বীজও দেখতে বাঁধাকপির মতো। বীজ থেকে চারা হয়। এ চারা পরবর্তীতে মূল জমিতে লাগাতে হয়। গাছের উচ্চতা জাতভেদে ২-৪ ফুট বা তারও বেশি হতে পারে। ফসলের জীবনকাল জাতভেদে ৯০-১৫০ দিন। সাধারণত দু-মাস পর থেকে গাছে স্প্রাউট আসা শুরু হয়। একটি গাছে ৪০-৬০টি স্প্রাউট হয়। গাছে যতগুলো পাতা থাকবে ততগুলো স্প্রাউট হবে। স্প্রাউটগুলো ৭-১০ সেমি আকারের এবং ওজন ৫০-৭০ গ্রাম হতে পারে। স্প্রাউট আসার ১৫-২০ দিন পর সংগ্রহ করা যায়। সপ্তাহে ১-২ বার গাছ থেকে স্প্রাউট তোলা যায়।
অন্যান্য কপিজাতীয় ফসলের তুলনায় ব্রাসেলস স্প্রাউটের জীবনকাল দীর্ঘ হওয়ায় সারের মাত্রা একটু বেশি লাগে। ইউরিয়া সার ৩-৪ বারে দিতে হয়। দ্রম্নত ফলন পেতে চাইলে চারা লাগানোর দুই মাস পর গাছের মাথা ভেঙে দিতে হবে। একে টপিং বলে। টপিংয়ের ফলে স্প্রাউটের সংখ্যা কমে গেলেও স্প্রাউটের আকার ও ওজন বাড়ে। ব্রাসেলস স্প্রাউটে রোগ-বালাই অনেকটা বাঁধাকপির মতো। তাপমাত্রা বাড়লে গাছের বয়স্ক পাতায় অল্টারনারিয়া ছত্রাকজনিত দাগ ও বস্নাইট রোগ দেখা দেয়। আবার এক ধরনের লেদাপোকা অনেক সময় স্প্রাউটগুলো বাহির থেকে খেয়ে ফেলে। যথাযথ ছত্রাকনাশক ও কীটনাশক স্প্রে করে এগুলো সফলভাবে দমন করা যায়।
তবে ব্রাসেলস স্প্রাউটের বাণিজ্যিক চাষের আগে আরও কিছু গবেষণা প্রয়োজন রয়েছে। যেমন- চারা লাগানোর সময়কাল নির্বাচন, তাপসহনশীল জাতগুলো নির্বাচন, স্বল্প জীবনকালের জাত উদ্ভাবন, টপিংয়ের সময়কাল নির্ধারণ, ফলন বাড়াতে বিভিন্ন সারের ব্যবহার ও মাত্রা নির্ধারণ, হরমোন প্রয়োগে আগাম ফলন সম্ভাব্যতা যাচাই, রোগ-বালাই নিয়ে গবেষণা, পেস্ট রিস্ক এনালাইসিস করা, উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন, বীজ উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং সর্বোপরি উৎপাদন খরচের সঙ্গে লাভের সম্ভাব্যতা যাচাই। এই গবেষণাগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্রাসেলস স্প্রাউট চাষের লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব।
বাংলাদেশ সবজি বৈচিত্র্যে ভরপুর দেশ। আর সে বৈচিত্র্যের নতুন পালক ব্রাসেলস স্প্রাউট। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, দেশে ১৪২ ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়। আর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। সারাবছরব্যাপী এখন দেশে উলেস্নখযোগ্য সবজি ফসল উৎপাদিত হয়। বিদেশি সবজির প্রতি নগরের জনসাধারণের বেশ আগ্রহ বিদ্যমান। তদুপরি দেশে এখন উলেস্নখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি নারী-পুরুষ কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া শহর-নগরের রেস্টুুরেন্টগুলোতে ভিন্ন স্বাদের খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ রয়েছে। সে বিবেচনায় এই নতুন সবজির চাষাবাদ বেশ লাভজনক হতে পারে। ইতিপূর্বে শেকৃবির প্রফেসর ড. নাহিদ জেবা গবেষণার মাধ্যমে মেক্সিকোর সবজি ফসল টমাটিলো এ দেশে সফলভাবে অবমুক্ত করেন। আশা করি ড. সোলায়মানের হাত ধরে শেকৃবির গবেষণায় এই নতুন সবজি ফসলের চাষাবাদ প্রযুক্তি সারা দেশে সম্প্রসারিত হবে, সেই কামনা করছি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
তথ্যসুত্র- দৈনিক যায়যায় দিন / কৃপ্র/এম ইসলাম