কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বাংলাদেশের জাতীয় কৃষিনীতিতে অগ্রাধিকার পেয়েছে’ন্যানো প্রযুক্তি’।Nanos’ থেকে ন্যানো শব্দটি এসেছে, যার আভিধানিক অর্থ ছোট বা খাটো। এটি একটি মাপের একক। ন্যানোমিটার স্কেল বিস্তৃত সকল প্রযুক্তিকে ন্যানো প্রযুক্তি বলা হয়।
নিরাপদ ও কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা, লাভজনক, উৎপাদনশীল, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করা। পাশাপাশি ফসলের উৎপাদনশীলতা ও কৃষকের আয় বৃদ্ধি, শস্য বহুমুখীকরণ, পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করাই ন্যানো প্রযুক্তির মুল উদ্দেশ্য।
বর্তমানে কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্যনিরাপত্তায় বিশ্বে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮-তে সবচেয়ে বড় সংযোজন হচ্ছে কৃষি উন্নয়নে ন্যানো প্রযুক্তি। আর এ কৃষি উন্নয়নে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো যথাক্রমে ফসলের রোগ নির্ণয়, জাতভিত্তিক পুষ্টি চাহিদা নির্ণয়, পুষ্টি আহরণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, ন্যানো সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ, কৃষি পরিবেশে ভারী ধাতুর উপস্থিতি শনাক্তকরণ ও শোধনসহ ন্যানো প্রযুক্তির সার, বালাইনাশক উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে উপকরণ দক্ষতা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ।
গবেষণায় দেখা গেছে বর্তমান বাংলাদেশের কৃষিতে বালাইনাশকের ৯৮ শতাংশের বেশি ও রাসায়নিক সারের ৫০ শতাংশেরও নানাভাবে অপচয় হয়। বর্তমানে এক কেজি চাল উৎপাদনে আমাদের তিন থেকে চার হাজার লিটার পানি ব্যবহার করতে হয়। এ অদক্ষ কৃষি উপকরণের ব্যবহারে যে ফসল উৎপাদন বাড়ছে তা নয়, সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও অব্যবহূত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ক্রমে বিপন্ন করে তুলছে। এসব মোকাবেলায় কৃষিনীতিতে উপকরণের ব্যবহার হ্রাসের লক্ষ্যে যুক্তিসঙ্গত কারণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ন্যানো প্রযুক্তির গবেষণা ও প্রয়োগে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার ও গবেষণায় উল্লিখিত চিহ্নিত ক্ষেত্রগুলো নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী।
তবে ন্যানো প্রযুক্তি কী? কীভাবে প্রয়োজনীয় ন্যানো কণাগুলো তৈরি করা হয় এবং কৃষিতে কীভাবে এর প্রয়োগ করা যাবে ইত্যাদি প্রশ্ন এখন দেশের কৃষিবিদ ও কৃষি বিজ্ঞানীদের। বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় সম্প্রতি ঢাকায় কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ) কর্তৃক আয়োজিত কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তি শিরোনামের একটি কনসালটেটিভ কর্মশালায়। যদিও ন্যানো প্রযুক্তি কোনো নতুন বিষয় নয়, তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদের কাছে এটি একটি নতুন বিষয় বলেই মনে হচ্ছে। এর কারণ দুটি— ১. কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠক্রমে এবং বিষয়বস্তুতে ন্যানো প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত নয়; ২. দেশে কৃষি গবেষণার অগ্রাধিকারভিত্তিক ক্ষেত্রগুলোয় ন্যানো প্রযুক্তি কখনো স্থান পায়নি।
জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮-তে ন্যানো প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি, কৃষি বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদদের এ নতুন বিষয়ে কৌতূহলী ও উদ্বুদ্ধ করেছে বলেই মনে হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ন্যানো প্রযুক্তি কী, বাংলাদেশে ন্যানো প্রযুক্তির গবেষণার বাস্তবতা এবং কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো কিছুটা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ হচ্ছে ২০১৩ সালে প্রণীত জাতীয় কৃষিনীতির হালনাগাদ ও সমৃদ্ধ সংস্করণ। এতে ২২টি অধ্যায় এবং ১০৬টি অনুচ্ছেদ ও উপ-অনুচ্ছেদ রয়েছে। প্রণীত কৃষিনীতির লক্ষ্য নিরাপদ, টেকসই ও লাভজনক কৃষি, খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা এবং দক্ষতার সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করা।
কৃষির ন্যানো প্রযুক্তিকে একুশ শতকের একটি সর্বাপেক্ষা কার্যকর প্রযুক্তি বলা হয়। কারণ এ প্রযুক্তি কৃষিক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই উন্নয়নে চমকপ্রদ অবদান রাখতে সক্ষম। ন্যানো টেকনোলজি এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ন্যানো প্রযুক্তি একটি কার্যকর ও সম্ভাবনাময় কৌশল হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। ন্যানো কণার ব্যবহার নাটকীয়ভাবে উদ্ভিদ পুষ্টি উন্নয়ন, সার ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি, ফসলে উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পানি ব্যবস্থাপনা, রোগ নির্ণয়, বালাই দমন, খাদ্য মোড়কীকরণ, অজৈব অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং নিখুঁত (প্রিসিশন) কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, নতুন ন্যানো কণা কার্যকরভাবে শস্য সংরক্ষণের জন্য বালাইনাশকের কার্যকারিতা ও নিরাপদ ব্যবহারে উন্নয়ন ঘটাতে পারে। অনুরূপভাবে ন্যানো সার স্লো রিলিজ বা ধীরে ধীরে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হওয়া এবং ধীর অবক্ষয়ের মাধ্যমে কার্যকরভাবে সার ব্যবহারের দক্ষতার প্রভূত উন্নয়ন করতে পারে। ন্যানো কণার ব্যবহার অথবা ন্যানো বাহকের ভেতরে সারের উপাদান ব্যবহার শস্যের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। টেকসই উদ্ভিদ পুষ্টি ও ফসল উৎপাদনের জন্য ন্যানো উপাদানের দক্ষতা আজ প্রমাণিত। সম্প্রতি ব্যাকটেরিয়াল ও ছত্রাকজনিত সংক্রামক রোগ দমনে জীবাণু
কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। তা সত্ত্বেও ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা সমাধানের জন্য গবেষণা করা প্রয়জন।
ন্যানো প্রযুক্তির অন্য আরেকটি চমকপ্রদ ব্যবহার হচ্ছে কৃষিবর্জ্য থেকে উচ্চমূল্যের দ্রব্যাদি তৈরি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করা।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে ন্যানো প্রযুক্তি যেসব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গবেষণা ও বাণিজ্যিক ব্যবহার করা প্রয়োজন, সেগুলো হলো উদ্ভিদ পুষ্টি, শস্য সংরক্ষণ, রোগ বিস্তার-সংক্রান্ত বিষয় ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস, রোগ নির্ণয়, জীবপ্রযুক্তি, প্রাণী স্বাস্থ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পণ্য প্যাকেটজাত, পানি ব্যবহার দক্ষতা উন্নয়ন।
বর্তমান বাংলাদেশ সরকার আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবান্ধব। কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৮ যে যথেষ্ট ভবিষ্যত্মুখী, তা প্রমাণ করে। যদিও বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে ন্যানো প্রযুক্তি কৃষকের মাঠপর্যায়ে এখনো তেমন একটা শুরু হয়নি। কিন্তু শিগগিরই কৃষিতে নানা রকম ন্যানো প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু হবে, তা আশা করা যায়। বাংলাদেশে কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে রোগ নির্ণয়, রোগবালাই ব্যবস্থাপনা ন্যানো পেস্টিসাইড, ন্যানো ফার্টিলাইজার, ন্যানো হার্বিসাইড, অগ্রাধিকারভিত্তিক ফুড প্যাকেজিং, ওষুধ ডেলিভারি, মৃত্তিকা দূষণ নির্ণয় ও দূরীকরণ, ফসল উন্নয়ন (জাত), উদ্ভিদে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধি, ন্যানো সেন্সর, সেচের দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ এবং নিখুঁত (প্রিসিশন) কৃষি। কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তি অনেক সম্ভাবনাময়, তবে বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ ও গবেষণায় ন্যানো প্রযুক্তি খুব একটা অন্তর্ভুক্ত নয়। সফল ন্যানো প্রযুক্তি উদ্ভাবনে রসায়নবিদ, পদার্থবিদ, বস্তু বিজ্ঞানী, কৃষি বিজ্ঞানী ও জীব বিজ্ঞানীদের যৌথ ও সমন্বিত গবেষণা প্রয়োজন। অন্যথায় এটি শুধু কাগুজে নীতি হিসেবে থেকে যাবে।
নতুন ন্যানো কণা যেমন— ন্যানো সার, ন্যানো বালাইনাশক, ন্যানো বাহক, ন্যানো সেন্সর, ন্যানো মোড়কীকরণ ও ন্যানো চিপ শস্যের স্মার্ট পুষ্টি, উন্নয়ন সংরক্ষণের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
এম ইসলাম