কৃষি প্রতিক্ষন ডেস্কঃ এক্যুয়াপনিক্স চাষ পদ্ধতি সারা বিশ্বে একটি কার্যকর এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রযুক্তি নির্ভর খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, যা ক্ষুদ্র বা বৃহৎ পরিসরে মাছ ও সবজির পরিবেশবান্ধব সমন্বিত চাষ পদ্ধতি বলে বিবেচিত। এই পদ্ধতি ভোক্তার স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য উৎপাদনে নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক্যুয়াপনিক্স-এর প্রকৃত সংজ্ঞা সহজভাবে বলতে গেলে-এক্যুয়াকালচার ও হাইড্রোপনিক্স বা জলজ প্রাণী ও সবজির সমন্বিত চাষকে বুঝায়। এই সমন্বিত চাষ পদ্ধতিতে মাটির প্রয়োজন হয় না। চাষীরা এই পদ্ধতিতে পানি পুনঃসঞ্চালন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাছ এবং সবজির সমন্বিত চাষ করে থাকে। মাছের মল ও বর্জ্য পদার্থ গাছ তার শিকড়ের মাধ্যমে পরিশোধন করে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। এতে আহরিত মাছ ও সবজি যেহেতু পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়, সেহেতু ভোক্তার খাদ্য নিরাপত্তার দিকটি বজায় থাকে। অনেক বিজ্ঞানীদের কাছে এক্যুয়াপনিক্স চাষ পদ্ধতি সমন্বিত চাষ ব্যবস্থাপনার একটি নতুর সংযোজন বলে ধারণা। আবার অনেক গবেষকদের মতে বর্তমানে যে সমন্বিত মৎস্য-সবজি চাষ পদ্ধতি দেখা যায় তাও অতীতের এই চাষ পদ্ধতির সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।একুয়াপনিক্স চাষ পদ্ধতিতে মাছের মল ও বর্জ্য পদার্থ গাছের শিকড়ের সাহায্যে নাইট্রোজেন ফিক্সিং ব্যাক্টেরিয়া, নাইট্রোজেনকে ভেঙ্গে নাইট্রাইট ও নাইট্রেট-এ পরিণত করে। গাছের শিকড় তা পরিশোধন করে পুষ্টি উপাদান শোষণ করে গাছের দেহ বৃদ্ধি ঘটায়। পরে পানি পুনঃসঞ্চালন পদ্ধতির মাধ্যমে এক্যুরিয়ামে ফিরে আসে এবং মাছ চাষের পানির পরিবেশ অক্ষুণœ রাখে। বর্তমান এক্যুয়াপনিক্স চাষ পদ্ধতি অতীতের এজটেক সম্প্রদায়ের কৃষি চাষীদের আধুনিক সংস্করণ।
বাংলাদেশে এক্যুয়াপনিক্স চাষ পদ্ধতির ব্যাপক বিস্তার ঘটতে চলছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্বিবিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদে ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিউটের গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে এবং আশানুরূপ ফল পাওয়া গেছে। এই পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য দিক হলো এটি একটি পরিবেশবান্ধব চাষ ব্যবস্থাপনা; যাতে অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ করে ট্যাংকের বা পুকুরের পানি দূষণ করে মাছের স্বাভাবিক উৎপাদন (রাসায়নিক সার ছাড়া) বৃদ্ধি করতে সক্ষম। বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে মাছ/সবজি চাষ যদিও একটি নতুন ক্ষেত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে, কিন্তু উন্নত দেশে এই পদ্ধতিতে চাষ অনেক আগে থেকে শুর হয়েছে। ভবিষ্যতে আমাদের দেশে এই পদ্ধতিতে চাষ বাস্তবায়ন প্রোটিনের চাহিদা মেটাবার পাশাপাশি ভোক্তার স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
বর্তমানে আমরা যে পদ্ধতিতে চাষ করছি তা স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রেইসেবিলিটি চাহিদা মোতাবেক চাষ করা স্বত্ত্বেও অনেক সময় কৃষি জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ অধিক বর্ষনের ফলে খামারের পানিতে মিশে যায়। এতে খামারের মাছে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বাধ্য হয়ে আমাদেরকে তখন রাসায়নিক সার/ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়।
বিশ্বের মধ্যে বাংরাদেশ একটি জলবহুল স্বল্প আয়তনের দেশ। আগামী ২০৫০ সালে এদেশে জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রাণীজ আমিষের চাহিদা মেটাতে দেশ হিমসিম খাবে। বর্তমানে আমরা জনপ্রতি ৬০ গ্রাম প্রাণিজ আমিষ পেয়ে থাকি। দেশে বর্তমানে মৎস্য উৎপাদন ৩৩ লক্ষ মেট্রিক টন। ২০৫০ সালে আগামী প্রজন্মের জন্য কমপক্ষে ৯০ লক্ষ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন করা দূরূহ হবে। বিজ্ঞানীদের একথাটি সত্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৩০ সালে প্রাণিজ প্রোটিনের অভাবে ১০ কোটি লোক বিশ্বে মারা যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের আগাম বার্ত ইলনিনো ও লানিনোর (Lanino) প্রভাব বিজ্ঞানীরা ১০০০ বছর আগে থেকে প্রত্যক্ষ করে আসছেন। মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা ও জলবায়ু পরিবর্তন মৎস্যকুলের জন্য অশনি সংকেত নিয়ে এসেছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনে মৎস্যের ওপর প্রভাব নিরসনে এক্যুয়াপনিক্স চাষ ব্যবস্থাপনা একটি নতুন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। আজ আমাদের ঘরে ঘরে বাড়ীর ছাদে কিংবা বারান্দায় কিংবা গাড়ি পার্কিং এলাকায় খালি জায়গায় এক্যুয়াপনিক্স চাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে প্রাণিজ আমিষ ও টাটকা সবজির চাহিদা মিটাতে পারি। যেহেতু এটি একটি পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতি সেহেতু ভোক্তার খাদ্য নিরাপত্তার জরুরি প্রয়োজনে টাটকা শাক-সবজি ও মাছ সরবরাহ করার জন্য পদ্ধতিটি কার্যকর হতে পারে। সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তাহলো অসময়ে বন্যা, খরা বা প্রতিকূল পরিবেশের প্রভাবকে মুক্ত রেখে এর চাষ কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া সম্ভব। এখন থেকে এক্যুয়াপনিক চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ, প্রচার ও জনসচেতনা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
এম ইসলাম