কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক:
আমাদের বাংলাদেশের কৃষকদের আবহমান কাল থেকেই আমন ধানে তাদের গোলা ভরে। আমন শব্দটির উৎপত্তি আরবী শব্দ ‘আমান’ থেকে যার অর্থ আমানত। অর্থাৎ আমন কৃষকের কাছে একটি নিশ্চিত ফসল বা আমানত হিসেবে পরিচিত ছিল। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রতিবছর আমনের উৎপাদন বাড়ছে আর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে নতুন নতুন উদ্ভাবিত জাত, আধুনিক ব্যবস্থাপনা।
বীজতলা তৈরি ও বীজ বপন
উঁচু এবং উর্বর জমিতে বীজতলা তৈরি করতে হবে যেখানে বন্যার পানি উঠার সম্ভাবনা নেই। যেসব এলাকায় উঁচু জমি নেই সেসব এলাকায় ভাসমান বীজতলা তৈরি করার জন্য পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। দীর্ঘ, মধ্যম ও স্বল্প জীবনকালের জাতের জন্য আলাদা আলাদা স্থান ও সময়ে বীজতলায় বপন করতে হবে। পরিমিত ও মধ্যম মাত্রার উর্বর মাটিতে বীজতলার জন্য কোন সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে নিম্ন, অতি নিম্ন অথবা অনূর্বর মাটির ক্ষেত্রে গোবর অথবা খামারজাত সার প্রতি শতকে ২ মণ হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে। ভাল চারা পাওয়ার জন্য ভাল বীজের বিকল্প নেই। তাই বিএডিসি, স্থানীয় কৃষি বিভাগ বা ব্রি কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভাল বীজ সংগ্রহ করে বীজতলায় বপন করতে হবে।
সাশ্রয়ী সার ব্যবহারের প্রযুক্তি
আমরা জানি, উদ্ভিদের নাইট্রোজেন এর অভাব পূরণে জমিতে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের জৈব সার (যেমন-সবুজ সার, আবর্জনা পচা সার, পচা গোবর), নাইট্রোজেন ফিক্সিং ব্যাকটেরিয়াল ইনোকুলাম প্রয়োগ এবং এ্যাজোলার চাষ বাড়ানো যেতে পারে। ব্রির তথ্যমতে, দুই সেমি পর্যন্ত পানিযুক্ত কাদা মাটিতে গুটি ইউরিয়া ও প্রিল্ড ইউরিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে শতকরা ২৫-৩০ ভাগ ইউরিয়া সাশ্রয় হয়। তবে জোয়ার-ভাটা অঞ্চলে গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার করে ভাল ফলন পাওয়া যায়। অন্যদিকে ডাই এমোনিয়াম ফসফেট বা ডিএপি ব্যবহার করলে একই সঙ্গে ইউরিয়া ও ফসফরাসের অভাব পূরণ করা সম্ভব। জিংক সালফেট (মনো বা হেপ্টা) সার ফসফরাস জাতীয় সারের সঙ্গে একত্রে ব্যবহার করা যায় না। এ সমস্যা সমাধানে জিংক সারের সর্বশেষ প্রযুক্তি চিলেটেড জিংক প্রয়োগ করা যেতে পারে। মূল জমিতে ধানের চারা রোপণের ২০-২২ দিন পর প্রথমবার এবং ৪০-৪৫ দিন পর দ্বিতীয়বার ১ লিটার পানিতে ১ গ্রাম লিবরেল জিংক স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যাবে। রোপা আমন ধানের জমি তৈরির সময় বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) ৩০০ কেজি জৈব সার ব্যবহার করলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৩০ ভাগ কমানো সম্ভব।
আগাছা ব্যবস্থাপনা
ধানক্ষেত ৩৫-৪০ পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে পারলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। হাত দিয়ে, নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে এবং আগাছানাশক ব্যবহার করে আগছা দমন করা যায়। রোপা আমন ধানে সর্বোচ্চ দু’বার হাত দিয়ে আগাছা দমন করতে হয়। প্রথম বার ধান রোপণের ১৫ দিন পর এবং পরের বার ৩০-৩৫ দিন পর। নিড়ানি যন্ত্র দিয়ে ধানের দু’সারির মাঝের আগাছা দমন হয় কিন্তু দু’গুছির ফাঁকে যে আগাছা থাকে তা হাত দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। যান্ত্রিক দমনে অবশ্যই সারিতে ধান রোপণ করতে হবে। আগাছানাশক ব্যবহারে কম পরিশ্রমে ও কম খরচে বেশি পরিমাণ জমির আগাছা দমন করা যায়। প্রি-ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপণের ৩-৬ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর আগে) এবং পোস্ট ইমারজেন্স আগাছানাশক ধান রোপণের ৭-২০ দিনের মধ্যে (আগাছা জন্মানোর পর) ব্যবহার করতে হবে। আগাছানাশক প্রয়োগের সময় জমিতে ১-৩ সেন্টিমিটার পানি থাকলে ভালো। আমন মৌসুমে আগাছানাশক প্রয়োগের পর সাধারণত হাত নিড়ানির প্রয়োজন হয় না। তবে আগাছার ঘনত্ব যদি বেশি থাকে তবে আগাছানাশক প্রয়োগের ৩০-৪৫ দিন পর হাত নিড়ানি প্রয়োজন হয়।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা
নিবিড় চাষাবাদ ও আবহাওয়াজনিত কারণে আমনে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব ও আক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। ফলে ক্ষতিকর পোকা দমন এবং ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। এলাকাভেদে আমনের মুখ্য পোকাগুলো হলো- মাজরা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, চুংগি পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং, বাদামি গাছ ফড়িং, সাদা পিঠ গাছ ফড়িং, গান্ধি পোকা, শীষকাটা লেদা পোকা ইত্যাদি।
পোকার ক্ষতির মাত্রা পোকার প্রজাতি, পোকার সংখ্যা, এলাকার সামগ্রিক পরিবেশ, জমি বা তার আশপাশের অবস্থা, ধানের জাত, ধানগাছের বয়স, উপকারী পরভোজী ও পরজীবী পোকামাকড়ের সংখ্যা ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল। ধান ক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকা দেখা গেলে এর সঙ্গে বন্ধু পোকা, যেমন- মাকড়সা, লেডি-বার্ড বিটল, ক্যারাবিড বিটলসহ অনেক পরজীবী ও পরভোজী পোকামাকড় কি পরিমাণে আছে তা দেখতে হবে এবং শুত্রুমাত্র প্রয়োজনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ দমন করলে রোপা আমন মৌসুমে শতকরা ১৮ ভাগ ফলন বেশি হতে পারে। ধানক্ষেতে ডালপালা পুতে দিয়ে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমানো যায়। আলোক ফাঁদ/সোলার লাইট ট্রাপের সাহায্যে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো পোকা, সবুজ পাতা ফড়িং ও গান্ধি পোকার আক্রমণ কমানো যায়। জমি থেকে পানি বের করে দিয়ে চুংগি পোকা, বাদামি গাছ ফড়িং এবং সাদা পিঠ গাছ ফড়িং পোকার আক্রমণ কমানো যায়।
রোগ ব্যবস্থাপনা
আমন মৌসুমে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, খোলপোড়া, ব্লাস্ট, বাদামি দাগ, খোল পচা, টুংরো, বাকানি, এবং লক্ষ্মীরগু (ঋধষংব ঝসধৎঃ) সচরাচর দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রোগগুলো হলো খোলপোড়া, ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া, ব্লাস্ট, টুংরো, বাকানি এবং লক্ষ্মীরগু রোগ। খোলপোড়া রোগ দমনের জন্য পটাশ সার সমান দু’কিস্তিতে ভাগ করে এক ভাগ জমি তৈরির শেষ চাষে এবং অন্য ভাগ শেষ কিস্তি ইউরিয়া সারের সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ভেজা ও শুকনা পদ্ধতিতে সেচ ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। এছাড়া ফলিকুর, নেটিভো, এবং স্কোর ইত্যাদি ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় প্রয়োগ করে সফলভাবে দমন করা যায়। ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাথমিক অবস্থায় ৬০ গ্রাম এমওপি, ৬০ গ্রাম থিওভিট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। থোড় বের হওয়ার আগে রোগ দেখা দিলে বিঘা প্রতি ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল কাটা, মাড়াই ও সংরক্ষণ
শীষে ধান পেকে গেলেই ফসল কাটতে হবে। অধিক পাকা অবস্থায় ফসল কাটলে অনেক ধান ঝড়ে পড়ে, শীষ ভেঙ্গে যায়, শীষকাটা লেদাপোকা এবং পাখির আক্রমণ হতে পারে। তাই মাঠে গিয়ে ফসল পাকা পরীক্ষা করতে হবে। শীষের অগ্রভাগের শতকরা ৮০ ভাগ ধানের চাল শক্ত হলে ধান ঠিকমতো পেকেছে বলে বিবেচিত হবে। এ সময়ে ফসল কেটে মাঠেই বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে।
তাড়াতাড়ি মাড়াইয়ের জন্য ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্র যেমন- রিপার, হেড ফিড কম্ভাইন হার্ভেস্টার ও মিনি কম্ভাইন হার্ভেস্টার ব্যবহার করতে হবে। ধান মাড়াই করার জন্য পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিতে হবে। কাঁচা খলায় সরাসরি ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নেয়া উচিত। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রং উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ভালোভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত বা সংরক্ষণ করতে হবে।
ধানের বীজ সংরক্ষণ
ভাল ফলন পেতে হলে ভাল বীজের প্রয়োজন। আমন মওসুমে নিজের বীজ নিজে রেখে ব্যবহার করাই উত্তম। এ কথা মনে রেখেই কৃষকভাইদের ঠিক করতে হবে কোন জমির ধান বীজ হিসেবে রাখবেন। যে জমির ধান ভালভাব পেকেছে, রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়নি এবং আগাছামুক্ত সে জমির ধান বীজ হিসেবে রাখতে হবে। ধান কাটার আগেই বিজাতীয় গাছ সরিয়ে ফেলতে হবে। মনে রাখতে হবে গাছের আকার-আকৃতি ও রঙ, ফুল ফোটার সময় ও শীষের ধরন, ধানের আকার আকৃতি, রঙ এবং সর্বশেষ ধান পাকার সময় আগে-পিছে হলেই তা বিজাতীয় গাছ। সকল রোগাক্রান্ত গাছ অপসারণ করতে হবে। এরপর বীজ হিসেবে ফসল কেটে এবং আলাদা মাড়াই, ঝাড়াই, বাছাই করে ভালভাবে রোদে শুকিয়ে মজুদ করতে হবে।
কৃষি প্রতিক্ষণ/ এম ইসলাম