কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ রমজানে বাজারগুলোতে যখন ইউরিয়া সার মেশানো চিকন মুড়িতে সয়লাব, তখন ঝালকাঠিতে চলছে সুস্বাদু মোটা মুড়ি ভাজার উৎসব। শুধু লবণ পানি মিশ্রিত চাল হাতে ভিজিয়ে তৈরি করা হচ্ছে এ সুস্বাদু মুড়ি। নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের ১০, রাজাপুর উপজেলার তারাবুনিয়া এবং কাঠালিয়া উপজেলার আমুয়া ইউনিয়নের ১০ গ্রামে চলছে মুড়ি ভাজার উৎসব। চলবে সারা রমজান জুড়ে। এসব গ্রামের মুড়ি দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে বিখ্যাত। রমজানে এ গ্রামগুলোর মুড়ি দক্ষিণাঞ্চলবাসীর চাহিদা মেটানোর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। অন্যসব পরিচয় হারিয়ে বর্তমানে এ গ্রামগুলো মুড়িগ্রাম নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
জানা যায়, নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের রাজাখালি, দপদপিয়া, তিমিরকাঠি, ভরতকাঠি ও জুরকাঠিসহ ২০টি গ্রামের অধিকাংশ মানুষের প্রধান পেশা মুড়িভাজা। ৪৫ বছর ধরে এ গ্রামগুলোর প্রতিটি ঘরে গভীর রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে মুড়ি ভাজা। রমজানে তা উৎসবে মাত্রা যোগ হয়। এসময় নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও এ কাজে সময় দিচ্ছেন। এ গ্রামগুলোতে যে মুড়ি ভাজা হয়, তার বেশির ভাগই দেশী মোটা চালের মুড়ি বা নাখোচি ধানের মুড়ি। ক্ষতিকারক মেডিসিন ছাড়াই চালগুলো শুধু লবণ ও পানি দিয়ে জলন্ত উনুনে বালি দিয়ে হাতে ভিজিয়ে তৈরী করা হয় সুস্বাদু এ মুড়ি। শুধু এই ২০টি গ্রামেই নয়, এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে জেলার প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রামে হাতে তৈরি মুড়ি ভাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন এক হাজারেরও বেশি পরিবার।
মুড়ি তৈরির কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার মানুষগুলো দুই পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। প্রথমত যারা একটু স্বচ্ছল তারা নিজেরা বাজার থেকে ধান কিনে তা বিশেষভাবে প্রক্রিয়াজাত করে চাল তৈরি করেন। তারপর মুড়ি ভাজিয়ে নিজেরাই বাজারজাত করে থাকেন। এতে স্বাভাবিকভাবেই তারা বেশি লাভবান হন। তারা প্রতি মণ মুড়ি থেকে কম বেশি দুইশো টাকা আয় করেন। অন্যদিকে যারা আর্থিকভাবে তেমন স্বচ্ছল নন, আড়ৎদাররা তাদেরকে বিনামূল্যে চাল দিয়ে থাকেন। এ চাল দিয়ে তারা মুড়ি ভাজিয়ে আড়তে দিয়ে আসেন। এতে আড়ত থেকে তাদের মুড়ি ভাজার মজুরী মেলে। মজুরী হিসেবে তারা পান দেড়শো টাকার মত। তবে মুড়ি ভাজতে জ্বালানী কাঠ ও আনুষঙ্গিক কিছু খরচ বাদে তাদের ১০০ থেকে ১২০ টাকার বেশি থাকে না বলে জানান দক্ষিণ তিমিরকাঠি গ্রামের বাবুল ভূঁইয়া। সাধারণত: ২ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন ২ মণ পর্যন্ত মুড়ি ভাজতে সক্ষম।
দপদপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল মৃধা বলেন, ‘এখানে মুড়ি ভাজা এখন একটি শিল্প। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় প্রতিটি পরিবার, ফলে আমার এলাকায় দারিদ্র্যের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।’ তিনি আরো বলেন, এখানে যারা অন্য পেশার সঙ্গে জড়িত তারাও ফাঁকে ফাঁকে মুড়ি ভাজিয়ে বাড়তি দু’পয়সা রোজগার করে থাকেন।
দপদপিয়ায় বছরে প্রায় ২ কোটি টাকার মুড়ি উৎপাদন হয় বলে জানান মুুড়ি আড়তের মালিক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী হাওলাদার। অবশ্য এর একটা বড় অংশ হয় রোজার মাসে।
তিমিরকাঠি গ্রামের শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন জানান, ‘বাজারের অন্যসব মুড়ির চেয়ে এখানকার মুড়ির দাম একটু বেশি। তবে মুখে নিলে এই বেশি দামের কথাটা আর মনে থাকে না। এর স্বাদ একবার যে পেয়েছে তার মুখে অন্য কোন মুড়ি ভাল লাগার কথা নয়। এখানকার মুড়ির আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বর্তমানে রাসায়নিক সার দিয়ে মুড়ি ভাজার যে প্রথা চালু হয়েছে, তা এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।
মু
ড়ি আড়তের মালিক মোহাম্মদ বুরযুগ আলী বলেন, ‘বেশীরভাগ মেশিনে ভাজা মুড়িতে সার মেশানো হয়, ফলে তা থেকে কেমন যেন একটা গন্ধ আসে। আমরা যে পদ্ধতিতে মুড়ি ভাজি, তাতে খরচ একটু বেশি পড়ে। সাধারণত ৭৫ কেজি নাখুচি ধান থেকে ৫০ কেজি চাল পাওয়া যায় যেটা সনাতন পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করে চালে পরিণত করতে খরচ পরে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এখানকার মুড়ির চাহিদা রয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে হাতেভাজা মোটা মুড়ি। রমজানের শুরুতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে সুস্বাদু এই মুড়ি কিনে নিয়ে যান। ঝালকাঠি বিসিকের কর্মকর্তা মো. আল-আমিন বলেন, ‘মুড়ি ভাজার সাথে জড়িতদের বিসিকের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।
সুত্র ঃ বাসস