“মাত্র তিন লাখ টন উৎপাদন বাড়লে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ং সম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ”
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর গ্রীষ্মে হঠাৎই ভারতীয় পেঁয়াজ রফতানি বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে যায় ফলে ২০১৯ সালে ৩০০ টাকা কেজিতেও পেঁয়াজ কিনতে হয় ভোক্তাদের।
এরপর বাংলাদেশ কৃষি বিভাগ পেঁয়াজের আমদানি নিরভ্রতা দূর করে পেঁয়াজে স্বনির্ভরতা অর্জনে ওই সময় চার বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। প্রথম বছরই বিস্ময়কর সফলতা এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন ২৫ লাখ টন থেকে এক লাফে ৩২ লাখ টনে পৌঁছেছে। সে ক্ষেত্রে পেঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় স্থানটিও বাংলাদেশের দখলে চলে এসেছে। আগে ৩০ লাখ টনের কিছুটা বেশি উৎপাদনে এই অবস্থানে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পেঁয়াজ উৎপাদনে প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে চীন (২০০ লাখ টন) ও ভারত (৮১ লাখ টনের বেশি)।
বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদা ৩৫ লাখ মেট্রিক টনের মতো। সেখানে প্রতি বছর উৎপাদন হতো ২৫ লাখ টনের মতো। আর প্রায় ১০ লাখ টনের ঘাটতি নিয়ে অস্থিতিশীল ছিল পেঁয়াজের বাজার। আর মাত্র তিন লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হলে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকের পেঁয়াজের ন্যায্যমূল্য পাওয়া, উন্নত মানের বীজ নিশ্চিত করা, কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা এবং চাষাবাদের পরিধি বাড়ানোসহ নানা কারণে এই উৎপাদন বেড়েছে। বাজারে এখন তিন ধরনের পেঁয়াজ পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রকৃত দেশী পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৫০ টাকা, দেশে উৎপাদিত উচ্চ ফলনশীল পেঁয়াজের কেজি ৪৫ টাকা এবং ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি।
সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে পেঁয়াজের দাম বাড়তে দেখা যায়। বর্তমানে বাজার স্থিতিশীলই রয়েছে। পেঁয়াজের বাজার আগের মতো আর অস্থিতিশীল হবে না বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক বলাই কৃষ্ণ হাজারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য দেশে শীত ও গ্রীষ্মকালীন মিলিয়ে মোট পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ২৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন। কিন্তু উৎপাদন হয়েছে ৩২ লাখ মেট্রিক টন। যা আগের বছর তথা ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল ২৫ লাখ ৬০ হাজার টন। অর্থাৎ উৎপাদন বেড়েছে ছয় লাখ ৩৯ হাজার ২০০ হাজার টন, যা শতকরা হারে ২৪.৯৬ শতাংশ বেশি।
ডিএইর তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দুই লাখ ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করা হয়েছিল। গত অর্থবছরে ১৫ হাজার হেক্টর বেড়ে দুই লাখ ৫৩ হাজার হয়েছে। এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল দুই লাখ হেক্টর। এ ছাড়া হেক্টরপ্রতি উৎপাদনও বেড়েছে গত মৌসুমে। আগের বছর প্রতি হেক্টরে পেঁয়াজের উৎপাদন ছিল প্রায় ১১ টন। গত মৌসুমে তা ১৩ টনের বেশি হয়েছে।
পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর, তথা চার বছর মেয়াদি রোডম্যাপ তৈরি করে কৃষি বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে রবি মওসুমে পেঁয়াজ চাষের জমি ছিল ২ লাখ ৩৭ হাজার হেক্টরের কিছুটা বেশি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহ জানান ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে ২ লাখ ৭৫ হাজার হাজার হেক্টর জমিতে (রবি ও খরিপ মওসুম মিলে) পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে পেঁয়াজের ঘাটতি ১০ লাখ টন থেকে কমিয়ে ২ লাখ ৩৫ হাজার টনে নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক বলাই কৃষ্ণ হাজারা বলেন, ঘাটতি নয়, যেভাবে উৎপাদন বাড়ছে এর মধ্যে দেশ পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে। বিদেশ থেকে আর আমদানি করতে হবে না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক বলাই কৃষ্ণ হাজারা বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়েছে।
বলাই কৃষ্ণ হাজরা আরও জানান গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আমাদের জাতের নাম বারি-৫। এর মাদার জাত হচ্ছে ভারতের এন-৫৩। ভারত থেকে ১৮ মেট্রিক টন এই উন্নতজাতের বীজ আনা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এবং গবেষকরা এই বীজের চারা তৈরি করছেন। এই চারা কৃষকদের মাঝে বণ্টন করা হবে। এজন্য তালিকা প্রণয়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই বীজের ফলন ভালো। হেক্টরপ্রতি প্রায় ২০ টন উৎপাদন হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মো: হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে আমাদের চার বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় এ বছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩০ লাখ টন। হয়েছে ৩২ লাখ টনেরও বেশি। আগামী বছরেই আশা করি টার্গেট পরিপূর্ণ হবে। তিনি বলেন, পেঁয়াজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গ্রীষ্মকালীন চাষেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমরা কৃষককে প্রণোদনা হিসেবে ভারত থেকে আনা উন্নতজাতের পেঁয়াজের বীজ থেকে তৈরি চারা ও সার সরবরাহ করছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহ বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদন এবার একটু বেশি হয়েছে। ফলন ভালো। এজন্য বাজারেও দাম কম। আমাদের মূল টার্গেট ছিল তিনটি বিষয়ে। প্রথমত. এরিয়া বৃদ্ধি করা, দ্বিতীয়ত. উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং তৃতীয়ত. লস (পচে যাওয়া) কমানো। তিনটি টার্গেটই মোটামুটি পূরণ হয়েছে। প্রথম বছরেই চাষের এরিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪ হাজার হেক্টর। উৎপাদন বৃদ্ধি হেক্টরে ২ টন আর পচন যেটা হয় সেটাও কমিয়ে ফেলেছি। তিনি বলেন, কৃষককে ভারতীয় বীজ থেকে তৈরি চারা ও সার সরবরাহ করা হবে।
আসাদুল্লাহ বলেন, আমাদের লক্ষ্য হলো পেঁয়াজে ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। আমরা সেটা অনেকটাই পেরেছি। চলতি বছর আরো বাড়বে। কারণ আমরা গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য ১৮ টন বীজ এনেছি। এর মধ্যে ১২ টন বীজের চারা তৈরি হয়ে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ তিনি বলেন, রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোর, রংপুর অঞ্চলের হর্টিকালচার সেন্টার, বিএডিসি, কৃষি গবেষণা ফার্মে চারা উৎপাদন হয়েছে।
কৃষি প্রতিক্ষণ / এম ইসলাম