কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্ক :হাওরে ধান কাটা এখন প্রায় শেষ। চলছে ধান শুকিয়ে গোলায় তোলা। ফলে হাওরের কৃষকরা বেজায় ব্যস্ত। খবর কালের কণ্ঠ অনলাইনের।
কালবৈশাখী, বজ্রপাত, পাহাড়ি ঢলের চোখ-রাঙানিতে অতিষ্ঠ কৃষক শেষ পর্যন্ত হাওরের ধান কাটতে পেরে স্বস্তি প্রকাশ করছেন। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ১৯টি হাওরের কৃষক স্বস্তিতে নেই। তাঁরা দাবি জানিয়েছেন প্রণোদনার।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হাওরে আবাদ করা এক লাখ ৬৫ হাজার ২৩০ হেক্টর জমির মধ্যে কাটা হয়েছে এক লাখ ৫৯ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমির ধান। এর মধ্যে পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে ১৯টি ছোট-বড় হাওরের প্রায় পাঁচ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এই জমি বাদ দিলে আর মাত্র ১৪৭ হেক্টর জমির ধান কাটা বাকি আছে। আজ শুক্রবারের মধ্যে অবশিষ্ট এই ধানও কাটা শেষ হবে।
চলতি বছর জেলায় দুই লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমির মধ্যে হাওরে আবাদ করা হয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার ২৩০ হেক্টর জমিতে। হাওরের বাইরে বোরো আবাদ করা হয়েছে ৫৭ হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ৩২ হাজার ৭২ হেক্টর জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। হাওরে ৯৭ শতাংশ আর হাওরের বাইরে ৫৬ শতাংশ বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত শাল্লা, তাহিরপুর, ছাতক, জগন্নাথপুর উপজেলায় ধান সম্পূর্ণ কাটা শেষ হয়েছে।
সুনামগঞ্জের চারটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত দেখার হাওরের কয়েকটি ধানখলা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে ধান কাটা প্রায় শেষ। এই হাওরে এবার ৯ হাজার ৫৩৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। গত এক সপ্তাহ প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় ধান কাটা, শুকানো, মাড়াইয়ের কাজ সহজে করতে পারছেন কৃষকরা।
দেখার হাওরের রাবারবাড়ি গ্রামের কৃষক মুহিবুর রহমান তাঁর সর্বশেষ ৩০ শতাংশ জমির ধান কেটে ছেলেকে নিয়ে স্তূপ করে রাখছিলেন হাওরের জাঙ্গালে। চলতি বছর তিনি দুই একর জমিতে বোরো আবাদ করেন। বৃষ্টির পানিতে তাঁর ধান কিছুটা ডুবে গেলেও শেষ পর্যন্ত সব ধান কাটতে পেরে উচ্ছ্বসিত তিনি। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘শ্যাষম্যাস খেতের হকল ধান কাটতাম পারছি। শুকরিয়া। ’
গোবিন্দপুর গ্রামের কান্দায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কৃষকরা খুবই ব্যস্ত। কাটা ধান শুকানোর কাজ করছেন তাঁরা। ওই গ্রামের কৃষক মুরাদ মিয়া বলেন, ‘আমার ২৬ একর জমির মধ্যে ছয় একর জমি নিজে করেছি। বাকিটা বর্গা দিয়েছিলাম। আমার ক্ষেতের পুরো ধান কাটা শেষ। যারা বর্গা নিয়েছে, তারাও শেষ করেছে। যারা বিআর ২৮ লাগিয়েছিল তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ’
ওই গ্রামের কৃষক সাদিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা সব কৃষক সুন্দরভাবে ধান কাটতে পেরেছি। কোনো সমস্যা হয়নি। আমাদের হাওরে ১০০ ভাগ ধান কেটেছি। এখন শুকিয়ে ভাড়াতে আনার কাজ করছি। ’
কৃষি বিভাগ জানায়, জেলার ছোট-বড় ১৯টি হাওরের পাঁচ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমির বোরো ধান পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে নষ্ট হয়েছে। এতে প্রায় ২০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে বেসরকারি হিসাবে, অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর জমির ধান আর প্রায় ৪০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
১৯টি হাওরের ফসলডুবির ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দুটি কমিটিই তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে জানা গেছে।
শান্তিগঞ্জ উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কিষানি দিলতারা বেগম বলেন, ‘কিতা কইতাম বাবা, আউরো বাইচ্চাকাইচ্চা কোছও দিতে পারছে না। এক চিমটি ধানও আমরা পাইছি না। এখন ছলতাম কিতাদি? অসহায় অবস্থায় আছি। ’
ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে হাওর আন্দোলনের নেতাদের বক্তব্য হাওরের ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান নিয়ে গত ২৬ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে হাওর বাঁচাও আন্দোলন। ওই দিন নেতারা জানান, জেলায় ৩১টি হাওরের প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। কিন্তু কৃষি বিভাগ এ নিয়ে লুকোচুরি করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম দেখাচ্ছে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘সরকারিভাবে ক্ষয়ক্ষতির যে পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতি তার দ্বিগুণেরও বেশি। ’
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, ‘শুধু ক্ষয়ক্ষতিই নয়, লক্ষ্যমাত্রা, আবাদ ও উৎপাদন নিয়েও যে প্রতিবেদন দেওয়া হয় তার সঙ্গে মাঠের কোনো সম্পর্ক নেই। ঘরে বসে মাঠের প্রতিবেদন দেওয়ায় সরকার প্রকৃত তথ্য জানতে পারছে না। এতে মৌসুমে করণীয় ঠিক করা যাচ্ছে না। ফলে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘আমরা মৌসুমের শুরু থেকে মাঠে ধান রোপণ, কর্তন, উৎপাদন ও ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন দিয়ে থাকি। গতকাল পর্যন্ত হাওরের এক লাখ ৫৯ হাজার ৩০৮ হেক্টর জমির বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে। এবার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ১৩৭টি হাওরের কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দিয়েছিলাম। এরই মধ্যে প্রায় সব ধান কাটা শেষ। ’
তিনি বলেন, ‘যে অল্প জমিতে ধান কাটা বাকি রয়েছে, তা শুক্রবার (আজ) শেষ হবে। ’
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘প্রথম দিকে পাহাড়ি ঢল আমাদের হাওরগুলোকে চরম ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছিল। তবে প্রশাসনিক নজরদারি ও কৃষকদের তৎপরতায় হাওরের ধান কাটা শেষ করা গেছে, এটা বড় স্বস্তির। আমাদের খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলাসহ দেশে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ’
সুত্রঃ কালের কণ্ঠ অনলাইন / এম ইসলাম