তবে মাঠে গিয়ে ছবি না পাঠাতে পারলেও মাঠে বসে মোবাইল ফোন কলের মাধ্যমে সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা সমাধানের সেবা পাচ্ছেন বাংলাদেশের কৃষকরা। সরাসরি ১৬১২৩ এবং ৬৭৬৭ নম্বর দুটির মাধ্যমে তারা সমাধান পাচ্ছেন। ১৬১২৩ নম্বরে ফোন দিলে খামারবাড়ির কৃষি তথ্য সার্ভিসের বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে তথ্য সেবা পাচ্ছেন। এছাড়া ৬৭৬৭ নম্বরের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে তথ্য জানতে পারেন বা কৃষি কর্মকর্তাকে তার মাঠে ডেকে নিতে পারবেন।
কৃষি বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষকদের দোরগোড়ায় কৃষি তথ্য পৌছে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে সব ধরনের গবেষণা কার্যক্রম চলছে। ফসলের চাষাবাদের ধরনের ওপর নির্ভর করে কৃষকদের তথ্য সংগ্রহ করে তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা হবে। প্রতিদিনই কৃষকদের জানিয়ে দেয়া হবে করণীয় সম্পর্কে। তারা বলছেন, কৃষি খামার ব্যবস্থাপনার বাণিজ্যিকীকরণ, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব, শস্যবহুমুখীকরণ ও নিবিড় কৃষি, ব্যয় কমানো কৃষিক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ। স্থানীয়ভাবে বংশপরম্পরায় অর্জিত জ্ঞান দিয়ে কৃষিবিষয়ক সমস্যার সমাধান এখন কঠিন। কৃষিতে আধুনিক ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় কৃষির সনাতনী জ্ঞান এখন আর যথেষ্ট নয়।
এক সময় কৃষক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তার কাছ থেকেই কৃষিবিষয়ক পরামর্শ নিতেন। আবার কর্মকর্তা কৃষকের বাড়ি গিয়েও পরামর্শ দিতেন। সপ্তাহে একদিন বা মাসে দু’/একদিন। কিন্তু এখন তা পাল্টেছে । নতুন নতুন তথ্য জানার প্রয়োজন হচ্ছে প্রতিদিনই। কিন্তু মাঠ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ে ১৪ হাজার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পদের বিপরীতে রয়েছে সাড়ে ১২ হাজার।
এ কারণেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা চলছে। কীভাবে প্রতিমুহূর্তে কৃষকের সাথে যুক্ত থাকা যায়। মোবাইল ফোন, রেডিও, টিভি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সিনেমা সবই কৃষক তথ্য সেবার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষকদের জন্য সরকারিভাবে একটি কমিউনিটি রেডিও চালু হয়েছে। বেসরকারিভাবে আরো ১৩টি রেডিও কৃষকদের তথ্য সেবা দিচ্ছে। সময়ের চাহিদায় একসময়ের ব্লক সুপারভাইজাররা এখন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা যাদের হাতে থাকে মোবাইল, কেউ কেউ ইন্টারনেটের মাধ্যমেও হালনাগাদ থাকেন কৃষি তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞানে। তথ্য চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিনই প্রয়োজন হচ্ছে নতুন নতুন পরামর্শ। নতুন নতুন পোকা ও রোগ ঠেকাতে নতুন নতুন তথ্য প্রয়োজন কৃষকদের। এ বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তথ্য সেবা এখন প্রযুিক্ত ভিত্তিক করার চিন্তা কৃষি বিভাগের।
৬৭৬৭ (ফারমারস হেল্প লাইন) : যে কোন নম্বর থেকে ৬৭৬৭ নম্বরে কৃষকরা ফোন দিলে তার সবচেয়ে কাছের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে পাওয়া যাবে। কৃষকদের সমস্যা সম্পর্কে তিনিই সব তথ্য দিবেন। ওই বিষয়ের জন্য প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কৃষককে জানাবেন। কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিজে গিয়ে কৃষকদের কৃষি বিষয়ক সমস্যার সমাধান করবেন। উক্ত কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগে ব্যর্থ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কৃষক পার্শ্ববর্তী উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাথে যুক্ত হবেন।
কৃষি কর্মকর্তা ফোন রিসিভ না করলে চতুর্থবারের বেলায় কৃষি বিভাগের স্থানীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মোবাইলে একটি এসএমএস চলে যাবে। যাতে ওই উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা কাজে গাফলতি করার সুযোগ না পান। তবে এ কাজের জন্য কৃষি কর্মকর্তা সুবিধা পাবেন। দেশের ১৪ হাজার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে বাংলা লিংক সিম প্রদান করা হবে। ইতিমধ্যে কয়েকটি জেলায় এ সেবা চালু হয়েছে। দেশের সব গ্রামেই এ সেবা পৌঁছে যাবে। এ বিষয়ে কৃষি বিভাগের সাথে বাংলা লিংকের একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে।
১৬১২৩ (কৃষি কল সেন্টার) : কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন কৃষি তথ্য সার্ভিস ও প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশ-এর যৌথ উদ্যোগে ঢাকার ফার্মগেটের খামারবাড়ির কৃষি তথ্য সার্ভিসে চালু হয় কৃষি কল সেন্টার। যে কেউ তার মোবাইল বা টেলিফোন নম্বর থেকে ১৬১২৩ নম্বরে ফোন দিলেই ওপর প্রান্ত থেকে জানতে চাওয়া হয় কৃষি, মত্স্য বা প্রাণী কোন বিষয় জানতে চাওয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট তথ্যের জন্য নির্দিষ্ট নম্বরে প্লেস করতে হয়। এরপর ওপর প্রান্ত থেকে সমস্যার কথা শুনে প্রয়োজনীয় তথ্য সেবা দেয়া হচ্ছে। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সেবা প্রদান করা হয়।
কৃষি তথ্য সার্ভিস ও প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন বাংলাদেশের ২০১১ সালের জুন মাসে কল সেন্টার বিষয়ে একটি প্রাথমিক দ্বিপক্ষীয় চুক্তি মোতাবেক খামারবাড়িতে কল সেন্টারটি স্থাপন করা হয়। ২০১২ সালের জুন মাসে পরীক্ষামূলকভাবে এর কার্যক্রম শুরু হয়। ইতিমধ্যে এ কল সেন্টার ২৫ হাজারের বেশি ফোন কল রিসিভ করেছে। ১৫ হাজার কলারকে কৃষি মত্স্য প্রাণিসম্পদসহ কৃষির বিভিন্ন বিষয়ের অনুসন্ধানের উত্তর তাত্ক্ষণিকভাবে দেয়া হয়েছে এবং বাকি অনুসন্ধানগুলোর উত্তর বিভিন্ন উত্স থেকে সংগ্রহ করে পরে কলারদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
ইনফরমেশন অন ফিঙ্গার টাচ নামে তথ্য সার্ভিসের সদর দপ্তরে একটি কিয়স্ক (বুথ) স্থাপন করা হয়েছে। টাচ স্ক্রিনের মাধ্যমে সহজেই এই বুথ থেকে কৃষিবিষয়ক অনলাইন/ অফলাইন কৃষি তথ্য নেয়া যাচ্ছে। কৃষকের জানালা নামে একটি সেবা রয়েছে কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের। এটি হচ্ছে মাঠ ফসলের বিভিন্ন সমস্যার ধারণকৃত ছবির তথ্য ভাণ্ডার যা ব্যবহার করে সমস্যা নির্ণয় এবং একই সাথে সমস্যার পরিবেশ বান্ধব সমাধান করবে এটি। যে কোন কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোনে এটি ব্যবহার করা যায়। এছাড়া কৃষকদের ডিজিটাল ঠিকানা নামেও একটি তথ্য সেবা রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটির।
কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) : আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি যত দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছানো যাবে, কৃষির উন্নতি তত দ্রুত হবে। এমন ধারণা নিয়েই বাংলাদেশ সরকার, ইউএনডিপি ও ড্যানিশ সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি তথ্য সার্ভিস, কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র বা এআইসিসি চালু করেছে। এ পর্যন্ত ২৪৫ টি গ্রামে তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখানে এসেই তথ্য সেবা নিতে পারছেন কৃষকরা। ক্রমান্বয়ে প্রতিটি গ্রামেই এই কেন্দ্র তৈরি হবে। এই সেবা কেন্দ্রে রয়েছে প্রজেক্টরসহ কৃষকদের সেবা দেয়ার সব ধরনের উপকরণ।
এখন মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করে তথ্য জানতে পারছেন কৃষকরা। http://baritechnology.org/m ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সব জাত, চাষাবাদ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাচ্ছে। এছাড়া এই অ্যাপসের মাধ্যমে বারি উদ্ভাবিত ফসলের উন্নত প্রযুক্তি, বিশেষ করে রোগবালাই, পোকা মাকড় ও সার ব্যবস্থাপনাসহ যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে। মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে এই অ্যাপসের মাধ্যমে কৃষকরা পাবেন সব তথ্য।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রয়েছে রাইজ নলেজ ব্যাংক নামে ইন্টারনেট ভিত্তিক একটি তথ্য সেবা। এর মাধ্যমে কৃষকরা ধানের সঠিক জাত, বপন/রোপণের কৌশল, সার ব্যবস্থাপনাসহ সব তথ্য জানতে পারছেন।
চলচ্চিত্র প্রদর্শন : ভ্রাম্যমাণ চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও আনন্দদানের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে খুব সহজেই কৃষকদের মাঝে প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা যায়। এ ধারণা নিয়ে কৃষি তথ্য সার্ভিস বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ কৌশল, উদ্বুদ্ধকরণ নাটিকা বা গান প্রচার করছে।