কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ লিচু বাগানে মৌ মাছির বাক্স বসিয়ে মধু আহরণ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন শতাধিক মৌ চাষি। লিচুর বাগানে এখন মৌচাষ হচ্ছে।এর ফলে একদিকে যেমন মৌ চাষিরা মধু সংগ্রহ করে লাভবান হচ্ছেন অন্যদিকে মৌ মাছির মাধ্যমে মুকুলে মুকুলে পরাগায়ণ ঘটায় লিচু গাছ মালিকরা ভাল ফলনের আশা করছেন। এক কথায় বাগানে মৌ চাষ করে মৌ চাষি এবং বাগান মালিক উভয়ে লাভবান হচ্ছেন। ধানের জেলা দিনাজপুরে প্রকৃতির রসগোল্লাখ্যাত ‘লিচু’ গাছে মৌ মৌ গন্ধে এজন্য বাতাসে দোল খাচ্ছে লিচুর মুকুল। বেদনা, বোম্বাই, মাদ্রাজি, চায়না থ্রি, কাঠালীসহ দেশীয় লিচু গাছগুলোতে এবার প্রচুর মুকুল ধরেছে। তাই, লিচু চাষিরা এখন ব্যস্ত লিচু গাছ পরিচর্যায়।
মৌ চাষ লাভজনক ফল হওয়ায় অনেকে ধান ও অন্যান্য ফসলের জমিতে লিচু গাছ লাগিয়েছে। দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলায় ২৪০০ হেক্টর জমিতে রয়েছে লিচুর বাগান। এছাড়াও বসতবাড়িতে ৪৪০ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে। ছোট-বড় মিলে সাড়ে ৩ হাজার বাগানে রয়েছে প্রায় ৩ লাখ ২৪ হাজারের বেশি লিচুর গাছ। সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৌ চাষি এসে বাগানে ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির মৌমাছির বাক্স বসিয়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৌ চাষ করে মধু সংগ্রহ করছেন। বাগানে তারা শতাধিক ব্রুড ও নিউক্লিয়াস নামের ছোট-বড় কাঠের বাক্স স্থাপন করেছেন।
প্রতিটি বাক্সে একটি রানি মৌমাছি, একটি পুরুষ মৌমাছি ও অসংখ্য এপিচ মেইলিফ্রা জাতের কর্মী মৌমাছি রয়েছে। কর্মী মৌমাছিরা মৌ মৌ গন্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে যায় লিচুর মুকুলে। পরে মুকুল হতে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছির দল নিজ নিজ কলোনিতে মৌচাকে এনে জমা করছে। ১০-১৫ দিন অন্তর প্রতিটি বাক্স হতে চাষিরা ৬-৭ মণ মধু সংগ্রহ করছেন। যে লিচু গাছে মৌমাছির আগমন বেশি হয় সে গাছের মুকুলে পরাগায়ন ভাল হয়। ফলে ওই গাছে বা বাগানে লিচুর যেমন বাম্পার ফলনের সম্ভবনা থাকে, তেমনি মৌ চাষিরা বেশি মধু সংগ্রহ করে বাণিজ্যিকভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারে। জেলার বিভিন্ন বাগান থেকে শতাধিক মৌ চাষি প্রতিদন ১৫ থেকে ২০ মণ মধু সংগ্রহ করে বাজারজাত করছে। কাঠের তৈরি শত শত বিশেষ বাক্সের মাধ্যমে মৌ চাষ মধু সংগ্রহ করা দৃশ্য দেখে এলাকাবাসীও উদগ্রীব হয়ে ছুটে আসছেন মধু কেনার জন্য লিচু বাগানে। ক্রেতা আবুল হোসেন জানান, বাজারে খাঁটি মধু পাওয়া যায় না। তাই স্বচক্ষে নির্ভেজাল মধু সংগ্রহ করতে পেরে তারা নিজেকে ধন্য মনে করছেন।
কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক গোলাম মোস্তফা জানান, চলতি বছর প্রতিটি লিচু বাগানে প্রচুর মৌমাছির আগমন দেখা দিয়েছে। লিচু গাছ থেকে মৌমাছি মধু আহরণের ফলে গাছে গাছে বেশি করে পরাগায়ণ হয় এবং শতকরা ৩০-৪০ ভাগ লিচুর বেশি ফলন হয়। লিচু বাগানে মৌমাছিদের গুণগুণ শব্দে মুখরিত পুরো এলাকা। তবে কোনো বন্য মৌমাছি নয়, বাক্সে চাষ করা শিকারি মৌমাছিই এমন গুঞ্জনে মুখরিত করছে চলতি মৌসুমে এই অঞ্চলে লিচুর মুকুলের উপর নির্ভর করে মৌয়ালরা এসেছে বিভিন্ন জেলা থেকে। সাথে নিয়ে এসেছে লাখে লাখে ঝাঁকে ঝাঁকে বিরল প্রজাতির রানি মৌমাছি।
মৌয়ালরা নিজেদের সুবিধামতো আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন এলাকার লিচু বাগানে। সেখানে দিনরাত পরিশ্রম করে মধু সংগ্রহ করছে। সরজমিন বিরল উপজেলার চেতরা বাজার গেলে চোখে পড়ে মধু সংগ্রহের বাস্তব চিত্র। সেখানে ১০-১৫ জন মৌয়াল বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউবা মুখোশ পরে পুরানো বাক্স থেকে মৌচাক বের করে মধু সংগ্রহের জন্য প্রস্তত করছে। আবার কেউ পুরানো বাক্স বদলিয়ে নতুন বাক্সে মাছিদের জন্য নিরাপদ আবাস্থল তৈরি করছে।
মৌয়ালদের মতো কর্মী মাছিরাও বসে নেই। মৌমাছিরা দল বেঁধে ঝাঁকে উড়ে গিয়ে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে বাক্সের চাকে জমিয়ে রাখতে ব্যস্ত রয়েছে। সেখানে মৌমাছি ও মৌয়ালদের কর্ম ব্যস্ততায় উৎসব মুখর হয়ে উঠেছে মধু মৌসুম। এ বিষয়ে কথা হয় সিরাজগঞ্জ থেকে আসা মৌয়াল চান মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, এ লিচু বাগানে মৌমাছির বাক্স রয়েছে আড়াইশ’। এখানে ৭-১০ দিনের মধ্যে বাক্সগুলো থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়। এ মধু সংগ্রহ অভিযান চলবে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। প্রতি সপ্তায় প্রায় ১২০০ মণেরও বেশি মধু সংগ্রহ করা সম্ভব।
কৃপ্র/ এম ইসলাম