কৃষি প্রতিক্ষন ডেস্ক : বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও উত্তরাঞ্চলে এক লাখ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্যকর উদ্যোগ ও তদারকির অভাব রয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, এই অঞ্চলের অন্ততঃ সোয়া এক লাখ হেক্টর জমি তুলা চাষের উপযোগী। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় তুলা চাষে কৃষকের লাভ বেশি। উৎপাদন বাড়লে বিদেশ থেকে তুলা আমদানি হ্রাস পাবে। কিন্তু নানাবিধ সমস্যার কারণে এই সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছেনা। তুলা চাষের জন্য গবেষণাগার থাকলেও নেই প্রয়োজনীয় উপকরণ, নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। সম্প্রসারণের উদ্যোগেও কোন গতি নেই। তুলা চাষে যথেষ্ট লাভের কথা কৃষকদের কানে পৌঁছানো হয়না। উৎপাদিত তুলা বাজারজাত করতেও যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে বলে কৃষকদের অভিযোগ।
সূত্রগুলোর দাবি, উত্তরাঞ্চলে প্রতি বছর দেড় হাজার কোটি টাকারও বেশি তুলা চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর উদ্যোগ নেই। আর এ কারণে এই সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গবেষকরা বলছেন, এই অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটি তুলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিদ্যমান তুলা গবেষণাগারের বেহাল দশা, কৃষক পর্যায়ে ধারণা না থাকা, বাজার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘসূত্রিতাসহ নানা সমস্যা বিরাজ করছে। ফলে প্রতি বছর বিপুল পরিমান সুতা বেশি দামে আমদানি করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশে সিবিএ ১ থেকে সিবিএ ১০ জাতের দেশী তুলা এবং রূপালী ১ ও ডিএম ১ জাতের হাইব্রিড তুলার চাষ হচ্ছে। সিবিএ ১১ থেকে সিবিএ ১৩ পর্যন্ত তিনটি জাতের বীজ অনুমোদনের জন্য কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা পড়ে আছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, তুলাগাছ কেবল সূতা তৈরির অন্যতম কাঁচামালই নয়, তুলা বীজ থেকে তেল ও খৈল হয়। অপরিশোধিত তুলা বীজের তেল সাবান তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আর পরিশোধিত তেল ভোজ্য তেলের সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের। তুলার খৈল গবাদি পশু ও মাছের খাদ্য হিসেবে বেশ উপাদেয়। অন্যদিকে তুলার জমিতে তুলা আবাদকালীন সময়েই একসঙ্গে চারটি সাথী ফসল ফলানো সম্ভব। আধুনিক পদ্ধতিতে ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটারের ফাঁকে ফাঁকে লালশাক, ডাটা শাক, ধনিয়া পাতা, গীমা কলমি, আলু, হলুদ, তরমুজ, আখ, মিষ্টি কুমড়া, আনারস, কলা, পেঁপে, আদা, মরিচ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল আবাদ করে একই সময়ে বাড়তি আয় করা সম্ভব। এছাড়াও তুলা কাঠি জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করেও বাড়তি আয় করা যায়। অন্যদিক তুলা চাষকালীন সময়ে তুলার সবুজ পাতা পড়ে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ানো যায়।
একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, তুলা চাষের জন্য বন্যার পানি উঠে না এমন দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এটেল দো-আঁশ মাটি প্রয়োজন। তিনি জানান, উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটি তুলা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এই অঞ্চলে ১ লাখ হেক্টরেরও বেশী জমি আছে যেগুলোতে তুলা চাষ করে এই অঞ্চলকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা সম্ভব। কিন্তু আবাদ করা হয় মাত্র ৩/৪ হাজার হেক্টরে। পুরো জমিতে তুলা আবাদ নিশ্চিত করা গেলে প্রতি বছর ২ লাখ মেট্রিক টন তুলা উৎপাদন সম্ভব হবে। যার বাজারমূল্য দেড় হাজার কোটি টাকার উপরে। এতে বাইরে থেকে সুতা আমদানির পরিমাণও কমে যাবে। বিপুল পরিমান অর্থ সাশ্রয় হবে সরকারের।
উত্তরাঞ্চলের ১৩টি জেলাকে ৩টি জোনে ভাগ করে বর্তমানে তুলা চাষ সম্প্রসারণের কাজ চলছে। এরমধ্যে রাজশাহী জোনের আওতায় রাজশাহী, নওগাঁ ও নাটোরে মোট ৫৬টি ইউনিট, রংপুর জোনের আওতায় রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও ঠাঁকুরগাঁওয়ে ২৭টি ইউনিট, বগুড়া জোনের আওতায় বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাটে ১৪টি ইউনিট অফিস রয়েছে। তুলা উন্নয়ন অফিস জানায়, উত্তরাঞ্চলের এই ১৩ জেলায় এই বিশাল সংখ্যক অফিসের তদারকিতে মাত্র ৩/৪ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা উৎপাদন করেন কৃষকরা। অন্যদিকে, রংপুর ও দিনাজপুরে দু’টি তুলা উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রে দীর্ঘদিন থেকে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ২ জন করে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদ শুন্য। এখানে গবেষণাগারের সাইনবোর্ড ঝুলানো হলেও ভিতরে কোন ল্যাবরেটরি নেই।
তুলা উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাতেও তেমন কোন কাজ নেই। তাদেরকে অফিসে অলস সময় কাটাতে হয়। তুলা চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে, তুলার ভালো জাত আবিষ্কার করতে এবং তুলাকে অর্থকরি ফসল হিসেবে দাঁড় করাতেও কোন কার্যক্রম নেই। আর উৎপাদিত তুলা বিক্রি করতে গিয়েও বিপাকে পড়তে হয় কৃষকদের। তুলা বিক্রির জন্য পৃথকভাবে কোন স্থান বা হাট নেই। ফলে সীমিত পরিসরে যে তুলা হয় তা যশোর-কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মধ্যস্বত্বভোগি ব্যবসায়ীরা কম দামে কৃষকদের কাছ থেকে কিনে বেশী দামে বিক্রি করেন। উত্তরাঞ্চলের তুলা উন্নয়ন অফিসগুলোর আশেপাশে তুলা বিক্রির বাজার স্থাপনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব সহজেই।
কৃপ্র/কে আহমেদ/ এম ইসলাম