কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ আধুনিকায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উষ্ণ হচ্ছে পৃথিবী। পরিবর্তিত হচ্ছে জলবাায়ু। জলবায়ু পরিবর্তনের শুধু একটি কারণ নয় অনেকগুলো কারণ বিদ্যমান। কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বনসহ বিষাক্ত গ্যাসের নিঃসরণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ গ্রিন হাউস গ্যাস ও মানব সৃজিত কর্মকান্ড দ্বারা পরিবেশ দূষণ। যেমন পারমানবিক বিস্ফোরন, শিল্পকারখানার বর্জ্য, কলকারখানা ও গাড়ি থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, বেশি বেশি ফসল পাওয়ার জন্য জমিতে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ গাছ কেটে সবুজ ধ্বংস অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পকারখানা স্থাপন, ইটের ভাটা, জ্বালানি ইত্যাদি।
জলবায়ু পরির্তনে ঝুঁকির কারণ :
১.দক্ষিণ এশিয়ার সংকটাপন্ন ভৌগলিক অবস্থানে বাংলাদেশ
২.সমান্তরাল ও নিচু ভূমি
৩.আঞ্চলিক ও বিশ্বজনীন চরম আবহাওয়া
৪. জনসংখ্যার ঘনত্ব
৫.দারিদ্রতা
৬. নিরাপত্তাহীনতা
৭.দূর্বল ও সমন্বয়হীন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা
৮.অতিমাত্রায় ঋতুবৈচিত্র
৯. দূর্বল অবকাঠামো
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের পরিবর্তন :
বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে, বেড়েছে গড় বৃষ্টিপাত, বেড়েছে বন্যা, হয়ে গিয়েছে সিডর, আইলা, রেশমির মতো ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। দরিদ্রতা বেড়েছে। জমির লবণাক্ততা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের তিন অঞ্চলের পরিবর্তন হয়েছে ।
১. উপকূলীয় অঞ্চল ২. হাওর অঞ্চল ৩. চরাঞ্চল।
পরিবর্তিত রূপ :
উপকূলীয় অঞ্চল :
১.জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার প্রভাব বেড়েছে
২.দূর্যোগ প্রবণতা বেড়েছে
৩.মিঠাপানির প্রবাহ কমেছে
৪.খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে
৫.কৃষি শ্রমিকের পেশা বদল হয়েছে
৬.সংরক্ষিত অরণ্য এলাকা ধ্বংস হচ্ছে
৭.মাছ কমে যাচ্ছে
৮.নদীর ভাঙন এবং নদীর গতি পরিবর্ততিত হয়েছে
হাওর অঞ্চল :
১. বিভিন্ন জাতের ধান হারিয়ে যাচ্ছে
২.গাছের প্রজাতি নষ্ট হচ্ছে
৩.খাদ্য সংকটের স্থায়ীত্ব বেড়েছে
৪. অকাল বন্যায় কৃষকেরা বীজ সংকটে
৫. নদী ভাঙনে বিস্তীর্ণ জনপদ। উদ্বাস্তু হয়েছে মানুষ
৬. বৈরী আবহাওয়ায় ধানের ফলন ভালো হয় না
৭. নদীর গভীরতা কমে গেছে
৮. আমনের আবাদ কমেছে বেড়েছে বোরর আবাদ
চরাঞ্চল :
১.ধানের প্রজাতি বিলুপ্ত হচ্ছে
২.বৃষ্টিপাত, শৈত্যপ্রবাহ, খরতাপ বেড়ে যাচ্ছে
৩. জৈব সারের উৎস কমে যাচ্ছে
৪. পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে
৫. শুকনো মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে
সব বিষয় বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই তিন অঞ্চলের মানুষ আর্থ-সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বেশি। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। যদিও বাংলাদেশে গ্রীণ হাউস গ্যাস নির্গমন ০.১৭ তবুও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষই ক্ষতিগ্রস’ হবে বেশি। যেমন উত্তরাঞ্চল, সেখানে অনাবৃষ্টির কারণে পানির অভাবে সৃষ্ট খরার প্রভাব। এই অঞ্চলের অনেক এলাকায় অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা এবং কর্মসংস্থানের অভাব থাকায় এমনিতেই মাঝে মাঝে মঙ্গা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনে এইসব এলাকায় যদি খরার প্রবণতা বাড়ে তাহলে অবস্থার অবনতি হবে। এবং দক্ষিণাঞ্চলে যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জোয়ারের লবণাক্ত পানির প্রবেশে জলাবদ্ধতা এবং জমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রভাব।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব :
১.বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের কারণে জমির লবণাক্ততাসহ নানাবিধ দুর্যোগের আঘাত
২.সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের প্রায় একদশমাংশ এলাকা সমুদ্র গর্ভে বিলীন হবে (বিজ্ঞানীদের মতে)
৩. পানি প্রবাহ বাধাগ্রস’ হবে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে পানির চাহিদা বাড়ার ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিবে
৪. কৃষি উৎপাদন ব্যহত হবে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস, অসময়ে বৃষ্টিপাত, ঘনকুয়াশার দ্বারা কৃষিব্যবস্থাপনা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে
৬.উপকূলীয় এলাকায় বাস্তু সংস্থান ও ভারসাম্য নষ্ট হবে
৭.উর্বর মাটির পরিমানগত এবং গুণগত অবনতি ঘটবে
৮.বন্যার স্থায়ীত্বের দীর্ঘসুত্রিতা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার বৈচিত্রতা, দীর্ঘস্থায়ী খরা, শীত-গ্রীষ্ম ও বর্ষায় তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতে পরিবর্তন
৯. সিডর, আইলা, রেশমির মতো ঘুর্ণি ঝড়ে জমির লবণাক্ত হওয়া, জমির ফসল নষ্ট হওয়া, ভাঙন ও ভূমিধ্বসে জমির পরিমান কমে যাওয়া
১০. উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়ের জমাট বরফ দ্রুত গলে যাওয়ার কারণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে। ভুমি ধ্বস বাড়বে। তারপর বরফ কমে গেলে হিমালয়ের পানি শুকিয়ে গেলে নদীগুলোতে পানির প্রবাহ কমে যাবে
১১. তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের কারণে আদ্রতার পরিবর্তন হয় যা কীটপতঙ্গ, রোগব্যাধী ও অণুজীবের বৃদ্ধির সহায়ক
১২. দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও বেশি পরিমানে বৃষ্টিএবং অসময়ে বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে মশার প্রকোপ বৃদ্ধি, ফলে ডেঙ্গুসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ-বালাইয়ের বৃদ্ধি ( গবেষণায় দেখা গিয়েছে বন্যার সময়ে পানি ও জীবাণুবাহিত রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে )
১৩. দারিদ্রতা বৃদ্ধি ( গবেষণা থেকে দেখা গেছে বিধ্বংসী বন্যা, সুনামি, জলোচ্ছ্বাস, সিডর, আইলা, রেশমির মতো ঘুর্ণিঝড়ের প্রকোপে অতি দরিদ্র মানুষেরা নিঃস্ব হয়েছে, দরিদ্ররা অতি দরিদ্র এবং অবস্থাপন্ন মানুষেরা দরিদ্র হয়ে পড়েছে।)
১৪.জলবায়ু উদ্বাস্তু বৃদ্ধি
১৫. ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব
১৬.মানুষ গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, বন্য পশুপাখি কীট পতঙ্গের প্রাণহানি
১৭. যদি উন্নত দেশগুলো জাতিসংঘের জলবায়ু তহবিল গঠনে সহযোগিতা হাত বাড়ায় তাহলে শিক্ষাখাত ও স্বাস্থ্যখাত ক্ষতিগ্রস্থ হবে
করণীয় :
১.জলবায়ু পরিবর্তনে প্রথমেই মানুষতে সচেতন হতে হবে। বিভিন্ন নীতি কৌশল বাস্তবায়নের সময় জলবায়ু সম্পর্কিত বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
২.বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস’ হবে কৃষিখাত। কীটনাশক ব্যবহার না করা। রাসায়নিক সার ব্যবহার না করা।
৩. নদী ড্রেজিং করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা
৪. বনায়ন করা
৫. প্রতিবছর দূযোগ পরিসি’তি মোকাবেলার জন্য সরকার তো বটেই জনগনকেও খাদ্য-শস্য মজুত করে রাখতে হবে
৬. টেকসই বাঁধ দিতে হবে যাতে জনপদে পানি না ঢুকতে পারে
৭. বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের এবং খাওয়ার উপযোগী করতে হবে
৮. উপকূল এলাকার ঘর তৈরির সময় জায়গা উঁচু করতে হবে এবং যাতে ক্ষতি না এমন ব্যবস্থা করতে হবে
৯. দূর্যোগ তহবিল গঠন করতে হবে ( সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে )
১০. নদী ভাঙন রোধের ব্যবস্থা করতে হবে
১১. জলবায়ুর প্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা, সচেতন হওয়া এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করা
জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে অসহায় দরিদ্র মানুষ এর মধ্যে নারী, শিশু ও প্রবীণ জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী ও শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ এবং এই পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞাত নয় এবং এই পরিস্থিতিতে কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে তার পূর্বপ্রস্তুতি সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। এই অবস্থায় করণীয়ই বা কী হবে সে সম্পর্কেও তারা ওয়াকিবহাল নয়। তাই জলবায়ু সম্পর্কে নারী ও শিশুসহ বাংলাদেশের মানুষকে ওয়াকিবহাল ভালোভাবে জানতে হবে বুঝতে হবে এবং কাজ করতে হবে। আর প্রবীণ জনগোষ্ঠী যদি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ প্রভাব সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ও তারা এই পরিসি’তি মোকাবেলা করতে অক্ষম। তাই জলবায়ু পরিবর্তনে নারী শিশু প্রবীণদের বিষয়ে দূর্যোগের আগে এবং পরে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
সূত্র: জনভাষ্য-৫, সম্পাদনা: আদিত্য শাহীন, চ্যানেল আই, মাটি ও মানুষ,২০১০
জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব : প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগার (সিডিএল)
ওয়েব সাইট ও বিভিন্ন পত্র পত্রিকা