স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত হিসেবে বিনা ধান ৭ এবং ব্রি ধান৬২ (জিংক সমৃদ্ধ) চাষ করা যায়, এ জাতগুলোর জীবনকাল ১০০-১১০ দিন এবং গড় ফলন প্রায় ৪৬৮ কেজি/বিঘা। স্বল্পমেয়াদি ও আগাম জাতের ধান চাষের জন্য সমকালীন চাষাবাদ খুবই গুরুত্ববহন করে।
অধিক ফলনশীল মাঝারি থেকে মোটা চালের জন্য বিআর১০, বিআর১১, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩১ চাষ করা যায়। এ জাতগুলোর জীবনকাল একটু বেশি হলেও (১৪০-১৫০দিন) গড় ফলন ৬৬৮-৭৩৫ কেজি/বিঘা। সুগন্ধি চালের জন্য ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৭, ব্রি ধান৩৮ চাষ করা যায়।
আগাম বন্যা সিলেট অঞ্চলে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। তাই বন্যার পানি বা জলমগ্নতা সহনশীল জাত ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২ চাষ করা যায়। এই জাতগুলো আকস্মিক বন্যায় প্রায় ১০-১৫ দিন জলমগ্ন থাকার পরও ফলন ভালো হয়। সাধারণত এ জাতগুলোর জীবনকাল ১৪২-১৫৫ দিন এবং ফলন গড়ে ৫৩৪-৬০০কেজি/বিঘা। নাবি জাত হিসেবে বিআর ২২, বিআর২৩, ব্রি ধান৪৬ অথবা স্থানীয় জাত যেমন শাইল জাতীয় ধানের জাত চাষ করা যায়।
উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা সহনশীল জাত ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩ এবং ব্রি ধান৫৪ চাষ করা যায়। জীবনকাল ১২৫-১৪৮ দিন এবং গড় ফলন প্রায় ৬০০ কেজি/বিঘা।
সিলেট অঞ্চলের আকস্মিক বন্যাপ্লাবিত এলাকার জন্য ব্রি ধান৫১, ব্রি ধান৫২; খরা প্রবন এলাকার জন্য ব্রি ধান৫৬, ব্রি ধান৫৭; স্বল্পমেয়াদি ব্রি ধান৬২, বিনা ধান-৭ এবং সাধারণ সকল জমির জন্য ব্রি ধান৪৯ এবং বিআর১১ খুবই উপযোগী।
জাত নির্বাচনের পাশাপাশি ভালো বীজ যেমন বিজাত মুক্ত, রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত, পরিপক্ক, পুষ্ট, চকচকে, সমআকৃতিবিশিষ্ট, সঠিক আর্দ্রতাযুক্ত (১২%) এবং কমপক্ষে ৮০% অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা সম্পন্ন বীজ সংগ্রহ করতে হবে। বীজ সংগ্রহের জন্য বিএডিসি বা কৃষক পর্যায়ের সংরক্ষণকৃত বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
বীজ সংগ্রহ করার পর বীজ বাছাই করে নিতে হবে। বীজ বাছাই আপনি তিন পদ্ধতিতে করতে পারেন। কুলা দিয়ে ঝেড়ে বা বাতাসে উড়িয়ে, হাতে বীজ বাছাই করে এবং ভাসমান পদ্ধতিতে। ভাসমান পদ্ধতিতে বীজ বাছাই করার জন্য, প্রথমে ১০ লিটার পরিষ্কার পানিতে প্রায় ৩৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার মিশাতে হবে। তারপর ১০ কেজি বীজ পানিতে ছেড়ে দিয়ে হাতে ভালোভাবে নাড়াচাড়া করতে হবে। পুষ্ট বীজ গুলো ডুবে যাবে এবং অপুষ্ট ও চিটাগুলো ভেসে উঠবে। হাত বা চালুনি দিয়ে ভাসমান বীজগুলো তুলে নিয়ে পরিষ্কার পানিতে ৩-৪ বার ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
বাছাইকৃত বীজ থেকে অল্প পরিমান নিয়ে বীজের অঙ্কুরোদগম পরীক্ষা করে নিবেন। মনে রাখবেন অঙ্কুরিত বীজ শতকরা ৮০ ভাগের উপরে হতে হবে অর্থ্যাৎ প্রতি ১০০ টা বীজের মধ্যে কমপক্ষে ৮০ টার উপরে সুস্থ স্বাভাবিক ধানের চারা গজাতে হবে তবেই একে আমরা ভাল বীজ বলব। নিজেরা সহজেই একটি প্লাস্টিকের পাত্রে সুবিধাজনক পরিমান ( দেড় থেকে দুই ইঞ্চি) বালি নিয়ে ১০০টি বীজ বসিয়ে দিতে পারেন। নিয়মিত পানি দেন। ১ বা ২ সপ্তাহ পরে চারাগুলো পরীক্ষা করুন। সুস্থ স্বাভাবিক চারা বলতে সঠিক আকৃতি ও অনুপাতে পাতা ও শিকড় থাকবে।
বাছাই করা বীজগুলো কাপড় বা চটের বস্তায় ভরে ঢিলা করে বেধে নিন। এরপর কেজি প্রতি বীজের জন্য এক লিটার পানি এবং দুই গ্রাম হারে ব্যাভিস্টিন/প্রোভেক্স/গিলজিম/হেডাজিম যে কোন একটি ,পাত্রে মিশিয়ে নিন। এরপর বীজের পোটলাটি ২৪ ঘন্টা পানিতে ডুবিয়ে রাখুন। এরপর বীজের পোটলাটি পানি থেকে সরিয়ে ইট বা কাঠের টুকরার উপর ঘন্টাখানেক রেখে দিন, পানি ঝরানোর জন্য। বীজ শোধনের জন্য কালো জামপাতার রস ব্যবহার করা যায়। এর জন্য ১৫০-২০০টি জামপাতা ভালোভাবে মিহি করে পেস্ট বানিয়ে ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ০৮ কেজি পরিমান ধান বীজ ৩০ মিনিট সময় ধরে ডুবিয়ে রাখতে হবে। অত:পর বীজগুলো হালকা রোদে একটু শুকাতে হবে। তারপর বীজ ভালোভাবে জাগ দিতে হবে।আমন ধানের বীজ জাগ দেওয়ার জন্য সময় লাগবে ৪৮ ঘন্টা বা দুই দিন। বীজের অঙ্কুর বের হলে বীজতলায় বপনের উপযুক্ত হয়।
প্রতি শতাংশ বীজতলায় ২ থেকে ৩ কেজি অংকুরিত বীজ সুষমভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। যা দ্বারা ২০-২৫ শতাংশ জমিতে রোপন করা যায়। আষাঢ় মাসই বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে মনে রাখতে হবে, রোপা আমন ধান ভাদ্র মাসের পর রোপন করা যাবে না।
বাড়ির কাছাকাছি উর্বর এটেল দো-আশঁ মাটি, পর্যাপ্ত আলো বাতাসযুক্ত স্থান, সেচ ও নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে এমন জায়গায় বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজতলাটি অবশ্যই আদর্শ বীজতলা হতে হবে।
এ পর্যায়ে আপনার মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী কৃষকদের সাথে আলোচনা করে, একসাথে বীজতলায় বীজ ছিটালে, একসাথে রোপন করলে, এক মাঠের সকলের ধান একই সাথে পাকবে এবং ফসল সংগ্রহ করা যাবে। একে আমরা সমকালীন চাষাবাদ বলি। এর ফলে ফসলের পোকামাকড় ও বিভিন্ন রোগ বালাই সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
মূল জমি নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাঝারি থেকে উর্বর জমি উত্তম। ছায়ামুক্ত, মোটামুটি সমতল, সেচ সুবিধাযুক্ত এবং বন্যামুক্ত হওয়া উচিত। কিছুদিন আগেই আপনি হয়ত বোরো ধান ঘরে তুলেছেন। জমিতে ধানের খড় কুটো বা আগাছা রয়েছে তাই আজই আপনি আপনার জমি একটি চাষ দিয়ে মই দিয়ে দেন। তাহলে ধানের খড়কুটোগুলো পচে গিয়ে সার হয়ে হবে এবং আগাছাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। মাটিতে ভালভাবে বাতাস চলাচল করতে পারবে এবং উন্মুক্ত রোদে অনেক রোগ জীবানু ধ্বংস হয়ে যাবে।
মূল জমি তৈরির সময় পরিমিত পরিমাণে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে। এজন্য মাটি পরীক্ষা করে বা অনলাইনের এফআরএস মাধ্যমে অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে হবে।
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমন ধানের উৎপাদন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাঠ পর্যায়ে আমন ধানের সর্ব্বোচ্চ ফলন উৎপাদনের জন্য প্রস্তুতির সহায়ক হিসেবে জাত নির্বাচন, ভালো বীজ সংগ্রহ, বীজ বাছাই, বীজ শোধন ও জাগ দেওয়ার সাথে সাথে আদর্শ বীজতলা তৈরি করা একান্ত দরকার। পাশাপাশি মূল জমি তৈরির ব্যবস্থা হাতে নেওয়া এখনই দরকার।
কৃপ্র/ কে আহমেদ/এম ইসলাম