কৃষি প্রতিক্ষন ডেস্ক : বাঙালি সংস্কৃতির একটি প্রাচীন ঐতিহ্য তাল পাতার তৈরি হাতপাখা। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার বিকাশ এবং বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটি হারিয়ে মেতে বসেছে । তারপরও নিতান্ত বাধ্য হয়েই বংশপরম্পরায় চলে আসা এই পেশাটিকে এখনো টিকিয়ে রাখছেন মাগুরার দুই শতাধিক পরিবার ।
তালপাখা বাঙালির দীর্ঘদিনের একটি ঐতিহ্য। এক সময় নতুন জামাই, কিংবা বাড়ির অতিথির জন্য ঘরে রকমারি পাখা রাখা হতো। চারদিকে রঙিন কাপড়ে বাঁধানো পাখা দিয়ে অতিথিকে সম্মান জানানো বাঙালির আতিথিয়েতার একটি বিশেষ দিক। শুধু তাই নয়, তাল পাতা নিয়ে সাহিত্যরও একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান। হাতপাখার নতুন পাতায় ‘তালের পাখায় মধু মাখা’ ইত্যাদি নানা ধরণের লোক সাহিত্য এখনো শোনা যায় মানুষের মুখে মুখে। এসব এখন বিলুপ্তির পথে।
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা গ্রামের বিশ্বাস পাড়ার ৩০টি পরিবারের প্রধান পেশা তাল গাছের কচি পাতা থেকে হাত পাখা তৈরি। যা স্থানীয় ছোট বড় ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে চলে যায় মাগুরা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। নহাটার পাখাপলীর বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে দেখা যায় প্রতিটি পরিবারেই এখন চলছে ব্যস্ততা। বছরের এ সময়টিতে বিশেষ করে গরমের মৌসুমে হাত পাখার চাহিদা অনেক থাকায় তাদের এ ব্যস্ততা। তবে বছরের অধিকাংশ সময়ই তাদের বেকার থাকতে হয়। যে কারণে ইতোমধ্যেই অনেকেই প্রাচীন এ পেশাটি ছেড়ে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।
বিশ্বাস পাড়ার মহম্মদ আলির মেয়ে দিতি। লেখাপড়া ও ঘরের কাজ সেরে সে সারাদিনই ব্যস্ত থাকে পাখা তৈরির কাজে। প্রতিদিন অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি পাখা তৈরি করতে পারে সে। যা বিক্রির পর উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ যেমন মিটিয়ে থাকে তেমনি অতিরিক্ত অর্থ তুলে দিতে পারে সংসারের জন্য। দিতি জানায়, বংশ পরম্পরায় তাদের পরিবার এই হাত পাখা তৈরি করে থাকে। এটিই তাদের একমাত্র পেশা। আর এ পেশার উপর নির্ভর করেই চলছে তাদের জীবন। বিশ্বাস পাড়ার পাখা শিল্পী সমর বিশ্বাস জানান, তাল গাছের কচি পাতা সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে শুকাবার পর পাখা তৈরির উপযোগী করে তোলা হয়। কিন্তু এখন গ্রামাঞ্চলে তাল গাছের সংখ্যা কমে গেছে। যে কারণে পাতা সংগ্রহ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এক সময় এসব পাতা এমনিতেই সংগ্রহ করা গেলেও এখন প্রতিটি পাতা ৫ টাকা দরে গাছের মালিকের কাছ থেকে কিনে আনতে হয়। যে কারণে এখন পাখা তৈরির খরচ বেড়ে গেছে।
এখন ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। যে কারণে হাত পাখার ব্যবহারও কমে গেছে। দিনে দিনে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরাও বেচে থাকার তাগিদে ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছে। আর যারা এখনো এ পেশাকে আকড়ে ধরে আছেন তাদের পক্ষেও বেশিদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।পাখা শিল্পী রমেশ বিশ্বাস বলেন, সব ধরণের জিনিসের দাম বাড়লেও সেই তুলনায় পাখার দাম বাড়েনি। তারপরও বংশ পরস্পরায় চলে আসা এ পেশাটি ধরে রাখতে গেলে অর্থ বিনিয়োগ জরুরি। তা না হলে এ পেশায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।
তবে প্রায় বিলুপ্ত এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ঋণ সহায়তা দেবার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
মাগুরা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের উপ-পরিচালক আনোয়ারুল সিদ্দিকি বলেন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। ঐতিহ্যপূর্ণ এ পেশা সংশ্লিষ্টরা ইচ্ছে করলে এখান থেকে ঋণ নিয়ে তাদের পেশাটির শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারে। মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার নহাটা গ্রাম ছাড়াও সদর ও শালিখার ১০টি গ্রামে অন্তত দুই শতাধিক পরিবার এখনো হাতে তৈরি তাল পাখা শিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বলে মাগুরার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সহায়ক কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কৃপ্র/ কে আহমেদ/ এম ইসলাম