‘কীটনাশক প্রয়োগের ২১ দিনের মধ্যে জমি থেকে শাক-সবজি সংগ্রহ করলে তা বিষ সমতুল্য’
ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, ওলকপি, শালগম, গাজর ও ব্রুকলিঃ পোকা, প্রজাপতি এসব সবজির পাতা ও ডগা খায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফুলকপি ও বাঁধাকপির মাথা ছোট হয় বা বাধে না।
দমনঃ বন গাজর, সরিষা, শালগম এসব উদি্ভদ এই সবজি ক্ষেতে রাখা যাবে না। হাতজাল দিয়ে ধরা যায়। আঠা লাগিয়ে আটকানো যায়। বাঁধাকপিতে কালোপচন রোগ হয়।
রোগের লক্ষণঃ চারাগাছের বীজপাত্রের কিনার কালচে দাগ হয়। পাতায় দাগ পড়ে। বীজ ১০ মিনিট গরম পানিতে ডুবিয়ে বপন করলে এ রোগ হয় না। এছাড়াও বোর্দমিকচার দেয়া যেতে পারে। বিকৃতমূল রোগ বাঁধাকপিতে হলে মূল স্ফীত হয়ে বিভিন্ন আকারের হয়। এ রোগ দমনের জন্য মাটি শোধন করে নিরোগ বীজতলায় চারা উৎপাদন করতে হবে। উক্ত সবগুলো সবজিতে হলদে হওয়া রোগ হয়। আক্রা- গাছের পাতার নিম্নাংশ বৃ- বরাবর খানিকটা অংশ প্রথম ঢলে পরে এবং পরে মরে যায়।
দমনঃ বীজ শোধন, শস্য পর্যায় অবলম্বন ফানজিসাইড প্রয়োগ এবং রোগক্রা- অংশ কেটে অন্যত্র ফেলে দিতে হবে। পাতায় দাগ রোগ হলে এসব সবজি পাতায় গোলাকার হলুদ দাগ পরে। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বীজ গরম পানিতে ডুবিয়ে রেখে পরে বপন করতে হবে। ডাউনি মিলডিও রোগে উক্ত সবজিগুলোর পাতা সাদা পাউডারের মত আবরণ পড়ে। রোগ দমনের জন্য বীজ গরম পানিতে ডুবানো, শস্য-পর্যায় অবলম্বন, পরিস্কার বীজতলায় চারা উৎপাদন ও সরিষা জাতীয় আগাছা দমন করতে হবে।
সিম, বরবটি, ফরাসি সিম, মটারগুটিঃ পোকামাকড়ঃ জাবপোকাঃ ফলের কচি অংশের রস চুষে খায়। এতে ফলন খুব কম হয়। ঝাঁক ধরে গাছের কচি ডগায় বসে রস খায়।
দমনঃ লেডিবার্ড বিটল, টাইগার বিটল নামক শিকারী পোকা গাছে রাখা। এরা জাবপোকা এর লার্ভা খায়। ছাই ছিঁটিয়ে, পানি স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়।
ফল ছেদক পোকাঃ সিমের কুঁড়ি ,ফুল ও ফল খেয়ে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে। ভেতরে ঢুকেও ফল খায় ও মলত্যাগ করে। দমনঃ আক্রা- সিম তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলা। শুককীট পরজীবী দ্বারা আক্রা- হয়।
রেড মাইটঃ গাছের পাতা ও ফুলের কুঁড়ি থেকে রস চুষে খায়।
দমনঃ গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলা। সঠিক দূরত্বে গাছ রোপণ করা।
অ্যানথাকনোজঃ সিমে বাদামি-কালো আঁকাবাঁকা দাগ পড়ে।
দমনঃ ফসল উঠানোর পর পরিত্যক্ত কাণ্ড -পাতা পুড়িয়ে ফেলা। নিরোগ বীজ বপন করা। ক্ষেত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
মরিচা রোগঃ গাছের কাণ্ডে, পাতায়, ফলে সাদা-হলুদ বর্ণের দাগ পড়ে ও পাতা শুকিয়ে যায়।
দমনঃ রোগ প্রতিরোধী জাত- ফ্লোরি, গ্রীন, ক্যানফ্রিজার, সেমিনোল জাতের শিম চাষ করা। সুস্থ, নিরোগ বীজ বপন করা। আক্রা- অংশ ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলা।
টমেটো ও বেগুনঃ ফল ছেদক পোকাঃ বেগুন ও টমেটো কচি অবস্থায় ছিদ্র করে রস খায়। ফলে টমেটো নষ্ট হয় বা পচে যায়। এর লার্ভা কচি ডগাও খায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
দমনঃ আক্রা- ডগা ও ফল ছিঁড়ে কীড়া মারতে হবে। ক্ষেত সবসময় পরিস্কার রাখতে হবে। ছাই ছিঁটিয়ে, আলোর ফাঁদ দিয়ে ও হাতজাল দিয়ে মাছি আটকানো যায়। কাজলা ও ঝুমকা জাতের বেগুনে এ পোকা আক্রমণ করে না বলে এগুলো চাষ করা উচিত।
নেতিয়ে পড়া রোগঃ চারা অবস্থায় ছত্রাক দ্বারা আক্রা- হয়ে গাছ নেতিয়ে পড়ে। বীজ বপনের পরেই বীজ ছত্রাক দ্বারা আক্রা- হলে চারা হয় না।
দমনঃ হালকা ঝুরঝুরে মাটিতে বীজ বপন করা, সেচ না দেয়া, মাটি সবসময় শুকনো রাখা। বীজ ও মাটি শোধন করে বীজ বপন করা।
লেইট ব্লাইট রোগঃ পাতা, কাণ্ড ও ফলে সাদা সাদা দাগ পরে।
দমনঃ আলু ও টমেটো পাশাপাশি জমিতে চাষ না করা। আক্রা- অংশ ছিড়ে পুড়িয়ে ফেলা।
আরলি ব্লাইট রোগঃ চারা গাছের কাণ্ড এবং বড় গাছের পাতায় বাদামি দাগ পড়ে।
দমনঃ আগাছা দমন, সুষম সার ব্যবহার ও প্রয়োজন মত সেচ দিতে হবে। বীজ শোধন করে বপন করা।
ফিউজেরিয়াম উইন্টঃ টমেটোর চারা গাছের বয়স্ক পাতাগুলো নিচের দিকে বেঁকে ঢলে পড়ে এবং মারা যায়।
দমনঃ মাটি শোধন ও বীজ শোধন করে বীজ বপন করতে হবে। রতন, অপূর্ব ও লালিমা জাতের টমেটোতে ঢলে পড়া রোগ হয় না।
অ্যানথ্রাকনোজ রোগঃ টমেটো ও বেগুনে কালো দাগ পড়ে। দাগগুলোতে পরে পচন ধরে ফল পড়ে যায়।
দমনঃ যে সব জমির ফসলে এই রোগ হয় সেখানে ৩ থেকে ৪ বছর পর পর টমেটো চাষ করা উচিত।
মোজাইক রোগঃ টমেটোর পাতায় সবুজ হলদে দাগ পড়ে। এতে ফলন কম হয়।
দমনঃ আক্রা- গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে কাজ করার সময় বিড়ি সিগারেট খাওয়া উচিত না। ক্ষেত পরিস্কার রাখতে হবে। জাবপোকা ছাই দিয়ে দমন করতে হবে।
মড়ক রোগঃ বেগুন গাছের কাণ্ডে ক্যাঙ্কার হয়। বাকল খসে পড়ে, বাতাসে ভেঙে পড়ে। বেগুন শুকিয়ে যায়। পাতায় দাগ পড়ে। গাছ মারা যায়।
দমনঃ নীরোগ বীজ বপন করা। বীজ শোধন করা। কালো ও কুচকানো বীজ বপন করা উচিত না।
পাতা ছোট হওয়া রোগঃ ভাইরাসের আক্রমণে পাতা ছোট হয়। গাছ বড় হয় না। পাতা হলুদ ও সাদা হয়। পাতায় কাটা থাকে না।
দমনঃ ধুতরা জাতীয় গাছ ধবংস করা। আক্রা- গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলা।
উক্ত পদ্ধতিতে রোগবালাই দমন ছাড়াও সকল শাকসবজির জন্য কিছু সাধারণ পদ্ধতি আছে।
২· জমির ভেতরে ও বাইরে আগাছা পরিস্কার করলে ক্ষতিকর পোকা আশ্রয় না পেয়ে অন্যত্র চলে যায়।
৩· সবজি সারিতে ও সঠিক দূরত্বে রোপণ করলে বাদামি গাছ ফড়িং আক্রমণ কম করে।
৪· মৌসুমের শুরুতে শাকসবজির বীজ বপন করলে রোগবালাই কম হয়।
৫· গভীরভাবে জমি চাষ করে রোদে শুকালে পোকা ও রোগ কম হয়।
৬· পর্যায়ক্রমে ফসল চাষ করলে পোকা ও রোগ কম হয়।
৭· আলোর ফাঁদ পেতে, জমিতে ডাল/কঞ্চি পুঁতে, হাত জাল দিয়ে, গর্তে পানি বা ধোঁয়া দিয়ে পোকা দমন করা যায়।
৮· সেক্স ফেরোমেন ফাঁদঃ প্রজননের সময় হলে স্ত্রী পোকার দেহ থেকে ফেরোমেন নামক রাসায়নিক পদার্থের গন্ধ বের হয়। এই গন্ধে পুরুষ পোকা আকৃষ্ট হয়ে স্ত্রী পোকার সাথে প্রজননে অংশ নেয়। বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ফেরোমেন রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে কৌটায় ভর্তি করে সবজি ক্ষেতে রাখে। ফেরোমেনের গন্ধে পুরুষ পোকা কৌটার চারপাশে ঘুরে ডিটারজেন্ট পানির মধ্যে পড়ে মারা যায়।
৯· নিম, নিশিন্দা, বিষকাঁটালী, তামাক ইত্যাদি ভেষজ কীটনাশকের মাধ্যমে পোকামাকড় দমন করা যায়।
সুতরাং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ না করে উক্ত অরাসায়নিক পদ্ধতিতে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করে বিষমুক্ত শাকসবজি উৎপাদন করা যায়।