কৃষি প্রতিক্ষন ডেস্ক : মাছে-ভাতে বাঙালি—বাংলার চিরাচরিত এই প্রবাদ অতীতের কল্পকথা হয়ে ছিল এত দিন। ক্রমাগত দূষণ ও দখলের কারণে নদী-খাল-বিল থেকে ক্রমাগত মাছ হারিয়ে এমন এক বাস্তবতা হয়ে উঠেছিল, যার আর উল্টোযাত্রা সম্ভব বলে কেউ মনেই করতেন না। কিন্তু গত এক যুগে সাধারণ মানুষের পাতে ফিরে আসতে শুরু করেছে মাছ। আর সেই মাছ স্বাদু পানির।
গত ৭ জুলাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বিশ্বের মৎস্য সম্পদের ওপর একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতেও বাঙালির খাদ্যতালিকায় মাছের উপস্থিতি বাড়ার চিত্র ফুটে উঠেছে।
‘দ্য স্টেট অব ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০১৬’ (মৎস্য ও মৎস্য চাষের পরিস্থিতি-২০১৬) শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মাথাপিছু বাৎসরিক মাছ খাওয়ার চেয়ে তিন গুণ বেশি মাছ খাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশিরা মাথাপিছু যে পরিমাণে মাছ খায়, তা এখন উন্নয়নশীল দেশের লোকজনের মাছ খাওয়ায় গড় পরিমাণের প্রায় সমান।
এফএও এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, চার বছর আগেও বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ ছিল বছরে ১৪ কেজি। চলতি বছরের হিসাবে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছর ১৯ কেজি করে মাছ খাচ্ছে। এফএওর হিসাবে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অধিবাসীরা বছরে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে সাত কেজি মাছ খায়।
বাংলাদেশের মানুষ এখন বিশ্বের মাছ খাওয়ার গড় মানের কাছাকাছি চলে এসেছে। এফএওর হিসাব অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু মাছের ভোগ ১৮ দশমিক ৮ কেজি আর বিশ্বের মাথাপিছু ভোগ ২০ কেজি। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর মাথাপিছু মাছের ভোগ ২৬ দশমিক ৮ কেজি।
এফএওর প্রতিবেদন বলছে, মৎস্যবিজ্ঞানীরা রুই, কই, পাঙাশ ও তেলাপিয়ার উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন বলেই মাছের উৎপাদন বাড়ছে। এটি দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের পথেও এক ধাপ অগ্রগতি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাবে, গরিবের মাছ হিসেবে পরিচিত পাঙাশ ও থাই কইয়ের ১১ শতাংশই চর্বি। পাঙাশ মাছের ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ প্রোটিন। আর কই ও তেলাপিয়া মাছে প্রোটিনের পরিমাণ প্রায় ১৭ শতাংশ। দেশের মানুষের প্রোটিনের যে চাহিদা, তার ৬০ শতাংশ এখন পূরণ হচ্ছে মাছ থেকে। ১০ বছর আগেও এটি ছিল ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, ‘পুকুরে চাষ করা পাঙাশ, কই ও তেলাপিয়া নিয়ে অনেকে নাক সিটকায়। কিন্তু আমাদের দরিদ্র মানুষের একটি বড় অংশ এই কম দামি মাছ খেয়ে তাদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। ফলে এই মাছ যাতে নিরাপদভাবে চাষ করা যায়, সে লক্ষ্যে সরকারের কাজ করা উচিত।’
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, শুধু পুকুর বা জলাশয় থেকে আসে মোট উৎপাদিত মাছের ৫৫ দশকি ১৫ শতাংশ। আর নদী বা খাল-বিলের মতো উন্মুক্ত জলাধার থেকে আসে ২৮ শতাংশ মাছ। তবে দেশের দক্ষিণে বিস্তীর্ণ সমুদ্র উপকূল থাকলেও সেখান থেকে মাত্র ১৭ শতাংশ মাছ আসে দেশের বাজারে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছায়েদুল হক বলেন, সমুদ্রসীমা জয়ের পর এখন সেখানকার মৎস্য সম্পদের ওপর জরিপ চালানো হচ্ছে। আগামী বছর থেকে সমুদ্রে পরিকল্পিতভাবে মৎস্য আহরণ শুরু হবে । এতে মাছের উৎপাদন আরও বাড়বে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা যাবে মাছ ।
হিসাব বলছে, নদ-নদীতে মাছের বিচরণ ক্রমাগত কমছে বটে, কিন্তু পুকুর-জলাশয়ে চাষ বাড়ছে। ২০১০ সালে সারা দেশে পুকুরে মাছ উৎপাদিত হয়েছে ১৬ লাখ টন। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেশে বর্তমানে ৩ লাখ ৭১ হাজার ৩০৯ হেক্টর আয়তনের পুকুর রয়েছে।
এফএও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মাইক রবসন বলেন, ‘এই প্রতিবেদন আবারও বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টি ও জীবিকার নিরাপত্তায় মাছের উৎপাদন কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা তুলে ধরল। তবে আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জলজ সম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহার করতে হবে।’ বাংলাদেশের মাছের প্রধান আশ্রয়স্থল নদী ও জলাশয়গুলোকে দূষণমুক্ত করার ওপরে জোর দিয়ে তিনি বলেন, সামুদ্রিক সম্পদের সঠিক আহরণ যদি সম্ভব হয় এবং জলাশয়ে দূষণ বন্ধ করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের মাছের উৎপাদন আরও বাড়বে।
কৃপ্র/ কে আহমেদ/এম ইসলাম