কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ আমাদের দেশে আখ স্বল্পতার কারনে যখন চিনিকলগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চিনি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে সেই সময়ে দেশে চিনির ঘাটতি পূরণ করতে এবার আবাদ শুরু হয়েছে সুগার বিটের। সনাতনী পদ্ধতিতে চিনিকলগুলোতে আখের রস থেকে চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি শীতপ্রধান অঞ্চলের ফসল সুগারবিট থেকে চিনি ও গুড় উৎপাদনের গবেষণায় এরই মধ্যে বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা সফলতা লাভ করেছেন। সুগারবিট থেকে গুড় ও চিনি উৎপাদনের পর ইক্ষু গবেষণা ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা আশা করছেন চলতি বছর থেকেই দেশে সুগারবিট উৎপাদন ও এ থেকে বাণিজ্যিকভাবে চিনি ও গুড় তৈরী সম্ভব।
শীতপ্রধাণ অঞ্চলের ফসল সুগারবিট দেখতে অনেকটা মূলার মতন। জমিতে চারা রোপণের ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে সুগারবিট জমি থেকে তোলা যায়। ইক্ষু গবেষণা ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা জানান, যেখানে আখ থেকে শতকরা ৬ থেকে ৭ ভাগ চিনি পাওয়া যায় সেখানে সুগারবিট থেকে শতকরা ১৪ থেকে ১৮ ভাগ চিনি উৎপাদনে তারা সক্ষম হয়েছেন। এর পাশাপাশি লবনাক্ত এলাকায় সুগারবিটের পরীক্ষামূলক চাষ করে সফলতা পাওয়ার পর বিজ্ঞানীরা দেশে সুগারবিটের উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভবনার আশা করছেন। আর এ কারণেই তারা ভাবছেন বাণিজ্যিকভাবে সুগারবিটের উৎপাদন ও চিনিকলগুলো গুলো সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদনে সক্ষম হলে দেশের চিনির ঘাটতির বিরাট অংশ পূরণ হবে।
ইক্ষু গবেষণা ইনষ্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহম্মদ খলিলুর রহমান জানান, দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ২৩ লক্ষ মেট্রিক টন চিনি চাহিদার দেশে যে চিনি উৎপাদন হয় তার পরিমাণ খুবই কম। শুধুমাত্র গত বছরে দেশে ১৫টি চিনিকলের উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টনের বিপরীতে চিনি উৎপাদন করা হয়েছে মাত্র ৬৯ হাজার ৩০৮ মেট্রিক টন। ঘাটতি থাকা বিপুল পরিমাণের এই চিনি বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। পাশাপাশি দেশের চিনিকলগুলো শুধুমাত্র আখের রস থেকে চিনি উৎপাদন করে থাকে। তিনি আরো জানান, আখ একটি দীর্ঘমেয়াদী ফসল হওয়ায় একদিকে আখচাষীরা তাদের জমিতে শুধুমাত্র আখের আবাদে দিন দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এর পাশাপাশি দেশে বিভিন্নভাবে কৃষি জমি কমে যাওয়ায় আখ উৎপাদনও কমছে। ফলে প্রয়োজনীয় আখ না পাওয়ায় চিনি উৎপাদনের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। ফলে দেশের চিনির চাহিদা পূরণ এবং চিনিকলগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য চিনি উৎপাদনের বিকল্প উৎস সুগারবিট ব্যবহার করার জন্য ইক্ষু গবেষনা ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ২০০২-২০০৩ মৌসুম থেকে গবেষনা শুরু করেন। ২০১১-২০১২ মৌসুমে এজন্য একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ইক্ষু গবেষণা ইনষ্টিটিউট সহ দেশের কয়েকটি স্থানে সুগার বিটের দুইটি জাত শুভ্রা ও কাবেরীর পরীক্ষামূলকভাবে সুগারবিটের আবাদ করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে আবাদ করা সুগারবিটের মধ্যে শুভ্রা জাত প্রতি হেক্টরে ৮২ দশমিক ৩৩ মেট্রিক টন এবং কাবেরী জাত প্রতি হেক্টর থেকে ৭৫ দশমিক ৭৭ মেট্রিক টন উৎপাদন পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উৎপাদিত সুগারবিট থেকে গড়ে শতকরা ১২ দশমিক ০১ ভাগ চিনি আহরন সম্ভব হয়েছে বলেও তারা জানান। এই গবেষণার সময় বিজ্ঞানীরা পরীক্ষামূলকভাবে লবনাক্ত প্রবণ এলাকা বলে পরিচিত সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাটে সুগারবিটের ঐ দুইটি জাত আবাদ করে হেক্টর প্রতি ৬৭ থেকে ৭৭ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফলন পেয়েছেন এবং সেখানে চিনি আহরনের হার ছিলো শতকরা ১২ ভাগ। বিজ্ঞানীরা জানান, ঠাকুরগাও চিনিকল এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে আবাদ করে শুভ্রা জাতের সুগারবিটের সর্বোচ্চ ফলন হেক্টরপ্রতি ১০৬ দশমিক ২১ মেট্রিক টন এবং শ্যামপুর চিনিকল এলাকায় সর্বোচ্চ ১৩৫ দশমিক ৮৫ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া গেছে। এ থেকে বিজ্ঞানীরা এখন সুগারবিট উৎপাদন তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা করছেন।
ইক্ষু গবেষণা ইনষ্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহম্মদ খলিলুর রহমান জানান, চিনিকল গুলোতে তাদের যন্ত্রপাতির সাথে অল্প কয়েকটি নতুন যন্ত্র সংযোজনের মাধ্যমে খুব সহজেই সুগারবিট থেকে সাদা চিনি উৎপাদন করা সম্ভব। তিনি বলেন, সুগারবিটের সমস্যা হলো আখের মত সেখান থেকে কোনো রস পাওয়া যায় না। একারনে সুগারবিটকে স্লাইস করে কেটে ডিফিউজার মেশিনে পানিতে তা মেশালে সুগারবিটের চিনি অংশ পানিতে দ্রবীভুত হয়ে যায়। সেই দ্রবণ জাল দিয়ে সহজেই গুড় বা চিনি পাওয়া যায়। এ বছর থেকে ঠাকুরগাও সুগার মিলে সুগার বিট থেকে চিনি পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন করা হবে বলে তিনি জানান।
পাবনা সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমল কান্তি সরকার জানান, চলতি মাড়াই মৌসুমে পাবনা সুগার মিলে ৯০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৬ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। মাড়াই এখনো চলছে। তিনি আরো জানান, মাড়াই অব্যাহত থাকলেও চলতি মৌসুমে আবর্জনাপূর্ণ আখ, পোকা যুক্ত আখ সহ নানা কারনে এই মাড়াই মৌসুমে মিলের রিকভারী হার অনেক নীচে নেমে এসেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে কাংখিত লক্ষ্যমাত্রার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশংকা দেখা দিতে পারে বলেও তিনি জানান।
বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনষ্টিটিউটের সাম্প্রতিক কিছু সাফল্য : ১৯৫১ সালে পাবনা জেলার ঈশ্বরদীতে মাত্র ১৭ জন জনবল নিয়ে ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রটিকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ চিনিকল সংস্থার (বর্তমান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা) নিকট হস্তান্তর করা হয়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ চিনিকল সংস্থা ১৯৭৪ সালে ‘ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করে যা ঈশ্বরদীতে প্রধান কার্যালয়সহ ঠাকুরগাঁওস্থ আঞ্চলিক কেন্দ্রসহ একনেক কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাহী আদেশ বলে ইক্ষু গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনষ্টিটিউটকে বিলুপ্ত করে ‘বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করা হয়। বর্তমানে ইনষ্টিটিউটে প্রজনন বিভাগ, কৃষিতত্ব ও ফার্মিং সিস্টেম বিভাগ. শারীরতত্ব ও চিনি রসায়ন বিভাগ, রোগতত বিভাগ, কীটতত্ব বিভাগ, মৃত্তিকা ও পুষ্টি বিভাগ, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, কৃষি প্রকৌশল বিভাগ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বিভাগ, অন-ফার্ম গবেষনা বিভাগ সহ ১০টি বিভাগে গবেষক, বিজ্ঞানী সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এর বাইরে বায়েটেকনোলোজী বিভাগ এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগ নামের দুটো বিভাগের প্রস্তাবও অনুমোদন হয়েছে।
ইনষ্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞনিক কর্মকর্তা ড. খলিলুর রহমান জানান, ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত তাদের বিজ্ঞানীরা আখের ৪১টি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। তিনি আরো জানান, গত তিন বছরে ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা উচ্চ ফলনশীল এবং অধিক চিনি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন তিনটি জাত উদ্ভাবন করেছেন। জাতগুলো হলো ঈশ্বরদী-৩৯, ঈশ্বরদী-৪০ এবং বিএসআরআই-৪১। এর মধ্যে ঈশ্বরদী-৩৯ এবং ঈশ্বরদী-৪০ জাতের আখ স্বাভাবিক জমির পাশাপাশি লবনাক্ত প্রবণ এলাকায় আবাদ করা যায়। এর বাইরে সাম্প্রতিককালে স্বাভাবিক জমি ( প্লেইন ল্যান্ড ) এর পাশাপাশি প্রচলিত এলাকা যেমন চর এলাকা, পাহাড়ের ঢালে ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা সফলভাবে আখ আবাদের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছেন। বিজ্ঞানীরা জানান, আখের পাশাপাশি গুড় উৎপাদনের জন্য উচ্চ ফলনশীল তাল, খেজুর গাছের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী ফসল আখের সাথে সাথী ফসল হিসাবে একই জমিতে আলু, পেঁয়াজ, রশুন, মটরশুটি, বাধাকপি, পালংশাক, গাজর, টমেটো, বেবীকর্ণ, লেটুস, ধনে, কালোজিরা, মেথী, মুগডাল, মৌরী, তিল, কচু ইত্যাদি শষ্য সফলভাবে আবাদের প্রক্রিয়াও ইনষ্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা সফলতার সাথে উদ্ভাবন করেছেন। বিজ্ঞানীরা জানান, সফলভাবে সাথী ফসল আবাদের মাধ্যমে একটি জমির বহুবিধ ব্যবহার নিশ্চিতের পাশাপাশি বছরে একই জমি থেকে কমপক্ষে ৪টি ফসল পাওয়া যাবে।
আখের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন এবং অপ্রচলিত অঞ্চলে আখ চাষ সম্প্রসারণের পাশাপাশি সহজে আখ চাষ এবং আখচাষীদের কাছে সহজে প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা চারা উৎপাদনের জন্য বার্ড চিপ কাটিং মেশিন, প্যাডেল পাম্প, জোরা সারি নালা তৈরীর যন্ত্র, মিনি হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট সহ বেশ কিছু যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন। এ যন্ত্রগুলোর অনেকগুলোই কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে বলেও কর্মকর্তারা জানান।