কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ বেশী লাভের আশায় তামাক চাষে নেমে সর্বস্ব হারিয়েছেন কক্সবাজারের একদল কৃষক। এখন তারা বলছেন, কাড়ি কাড়ি টাকা দিলেও তারা আর তামাক চাষে যাবেন না । সম্প্রতি উপকূলীয় জেলাটির চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে পাওয়া কৃষকদের এই তথ্য জেনে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান বলছেন, তামাকের নানা ক্ষতির মধ্যে নতুন এ দিকটি উন্মোচিত হল।
নিঃস্ব কৃষকদের একজন আব্বাস আহমদ, যিনি এক সময় মোটামুটি স্বচ্ছল জীবন যাপনই করতেন। তামাক চাষে গিয়ে এখন তার কোনো জমিই নেই। আব্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিটিসির (বিএটি’র পুরাতন নাম) লোক বুঝানোর পর পইল্যার বছর আমরা দুই জনে মিলি বিটিসির (ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোবাকো) লামাত (বান্দরবনের লামা) ২২ কানি (এক কানিতে ৪০ শতক) জমিত তামাক চাষ করি। ৭০-৮০টিয়া দরের পাতা ৪০টিয়া দর দিয়ি (প্রতিকেজি ৭০-৮০ টাকা দরের পাতা ৪০ টাকা দর দিয়েছে)। খচ্চতো হই গিয়োই (খরচ তো হয়ে গেছে)।
“গুনারি ২ লাখ টিয়া খচ্চের লাই এক কানি জমি বেচিয়ালাই ৭০ আজার টিয়া দি (২ লাখ টাকা ক্ষতি গুনে ৭০ হাজার টাকায় এক কানি জমি বিক্রি করে দিই)। মাইনষের বেইজ্জতি কেমনে হইতাম? পরে পোলাইন ছাওয়ালের লেহাপড়ার লাই, চইলবার লাই আবার বেচিয়ালাইলাম আদকানি (মানুষের কাছে বেইজ্জতি হব? পরে পোলাপানের লেখাপড়া আর চলার জন্য আবার আধাকানি জমি বিক্রি করি)।” পরের বছর ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের পাশে ১৪ কানি জমিতে আবার তামাক চাষ করে দুই লাখ টাকা লোকসান গুনে আবার আধাকানি বিক্রি করেন আব্বাস। এখন কেবল ভিটেটুকু রয়েছে তার। “উহ, পাতা খেতি…. (উহ, পাতা ক্ষেত…..)”-দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে আব্বাসের মুখ থেকে।
আব্বাস দুই বছর ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোবাকো, ৪ বছর ঢাকা টোবাকো, তিন বছর আবুল কোম্পানির কার্ডধারী চাষি হিসাবে তামাক চাষ করেছেন।
আব্বাসের উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি গেলেও শামসুল আলমের গল্পটি অন্য রকম। পূর্বপুরুষ কৃষক থাকলেও তিনি পেশা হিসাবে গাড়িচালনাকেই বেছে নিয়েছিলেন। সেই আয়ে ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভালোই ছিলেন, অল্প অল্প সঞ্চয়ে ৪-৫ লাখ টাকা জমিয়েও ফেলেছিলেন। তামাক চাষে লাভের কথা শুনে সঞ্চয়ের টাকা ঢেলে শামসুলও নেমে পড়েছিলেন তামাক চাষে। টানা কয়েক বছর লোকসান দিয়ে তিনি এখন ঋণগ্রস্ত। ঋণের টাকা দিতে না পেরে ২০১৫ সালে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। ড্রাইভিং করে আস্তে আস্তে ঋণ শোধ শুরু করলেও পুরো ভারমুক্ত এখনও হননি।
হাবিবুর রহমান নামে আরেকজন বলেন, তামাক চাষ করেছিলেন লাভের আশায়। লাভ হয়নি, লোকসান গুণে আধা কানি জমি বিক্রি করেন।
তিনি জানান, চাষের মৌসুমের আগে তামাক কোম্পানি এসে ঋণ নিয়ে এসে কৃষককে তামাক চাষে প্রলুব্ধ করে। ফসল ঘরে এলে পরের বছর স্বচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখায়। এই স্বপ্নের পেছনে ছুটে তার মতো অনেকে তামাক চাষে প্রলুব্ধ হন।
কৃষক কেন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে-কারণ খুঁজতে গিয়ে এই চাষিদের কাছ থেকে নানা বক্তব্য পাওয়া গেছে।আব্বাস বলেন, তামাকচাষীদের ঋণ দেওয়ার সময় যে দাম দেওয়া হবে বলে অঙ্গীকার করা হয়, শেষ পর্যন্ত সেই দাম দেওয়া হয় না।
এক সময়ের তামাক চাষি কাজী আলী আহমদ বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোম্পানি বিভিন্ন খরচ দেয়, উপকরণের জোগান দেয়। তাই অধিকাংশ কৃষক খরচের হিসাব করতে পারে না। কিন্তু উৎপাদিত তামাক বিক্রির জন্য কোম্পানির কাছে দিলে তারা সেখান থেকে ওই টাকাটি কেটে রাখে।
“এখানে বড় একটা ফাঁকি হয় তামাকের গ্রেডিংয়ে। সবচেয়ে ভালো মানের তামাককে প্রথম গ্রেড হিসাবে ধরা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোম্পানির প্রথম গ্রেডের তামাক ক্রয়ের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা থাকে। সেই লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ হয়ে গেলে তখন কৃষক প্রথম গ্রেডের তামাক নিয়ে গেলেও সেটাকে প্রথম গ্রেড হিসাবে কিনতে চায় না। দ্বিতীয় গ্রেড, সেটাও পূর্ণ হয়ে গেলে তৃতীয় গ্রেড ধরে কিনে। কৃষক তখন বড় মার খায়।”
শামসুল বলেন, “সঠিক দাম না দেওয়ার চেয়েও বড় ফাঁকটা খরচের হিসাবে। তারা সেই পরিবারকেই অগ্রাধিকার দেয়, যে পরিবারে কাজ করার লোক রয়েছে। যে পরিবারের নিজেদের কাঠের জোগান রয়েছে, অথবা যারা পাহাড় থেকে কাঠ আনতে পারে। কাঠ (তামাক পোড়াতে ব্যবহৃত) ও খাটনির টাকা ধরলে তামাক চাষে লাভের হিসাব করা সম্ভব না।”
হাবিবুর রহমান তামাক চাষ করেছিলেন লাভের আশায়; লোকসানে তাকে বিক্রি করতে হয়েছে জমি। শামসুলের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফেরদৌসী নাহার ও এএমআর চৌধুরী এক গবেষণায়। তাতে বলা হয়, চাষিরা তামাক চাষে নিজেরা যে শ্রম দেন, খরচের হিসাবে সেটাকে ধরেন না। অধিকাংশ কৃষক উচ্চমাত্রার শ্রমঘন এই কাজে নিজেদের এবং পরিবারের নারী ও শিশুদের শ্রম খাটিয়ে দৃশ্যত খরচ কমিয়ে আনেন।
ওই জরিপে দেখা যায়, ৫০ ভাগেরও বেশি শ্রমের জোগান কৃষকের নিজের পরিবার থেকেই দেওয়া হয়। যদি এই শ্রম হিসাবে ধরা হয়, তাহলে তামাকের লাভের হিসাব বড় অংশে কমে যাবে। তামাক চাষে গিয়ে নিঃস্ব হওয়া চকরিয়ার কৃষকদের অভিযোগ নিয়ে ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোবাকোর কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স ম্যানেজার আনোয়ারুল আমিনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি এই চাষিরা আসলেই তাদের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন।
তখন গত পাঁচ বছরে এই কোম্পানির জন্য তামাক চাষে গত পাঁচ বছরে চুক্তিবদ্ধ চকরিয়ার কাকারা ইউনিয়নের চাষিদের তালিকা চেয়ে ই-মেইল করা হয়। কিন্তু তার কোনো উত্তর মেলেনি।তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো বলছে, তামাক চাষের পক্ষে চাষিদের লাভের নানা হিসাব কোম্পানিগুলো দেখালেও বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল বরাবরই।
গত জানুয়ারিতে ঢাকায় এসডিজি অর্জন নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর স্পিকারদের সম্মেলনে ২৫ বছরের মধ্যে তামাক নির্মূলের ঘোষণা দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সেই ঘোষণার পর তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের দৃশ্যমাণ কোনো পদক্ষেপ না থাকার মধ্যে এই বিষয়ে দ্রুত একটি ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ করার কথা বললেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, “তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদেরকে এর ব্যবসায় হাত দিতে হবে।”
জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তামাক কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে-এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, “তামাক চাষে আমাদের কোনো কর্মসূচি নেই। আমরা কাউকে তামাক চাষ করতে বলিনি।”এখন তামাক কোম্পানি আবার টাকা নিয়ে আসলে তামাক চাষে যাবেন কি না- এই প্রশ্নে চকরিয়ার আব্বাস বলেন, “বস্তা বস্তা টাকা দিলেও আমি আর পাতা খেতি করবো না।”