ড. শামসুল আলম: বীজ, সার, সেচভিত্তিক সবুজ বিপ্লব শুরু হয়েছিল বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে ধান ও গমের উচ্চ উত্পাদনশীল বীজ উদ্ভাবনের মাধ্যমে। গম ও ধানের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের মধ্য দিয়েই বর্ণিত সবুজ বিপ্লবের শুরু। উচ্চ ফলনশীল গম ও ধান বীজ উত্পাদন কৃষির ক্ষেত্রে ছিল ‘ইতিহাসের একটি টার্নিং পয়েন্ট’। সে ঢেউ ক্রমান্বয়ে জোরদার হয়েছে বাংলাদেশেও। স্বাধীনতার পর এক কোটি টনের কিছু উপরে খাদ্যশস্য উত্পাদনের পরিমাণ বেড়ে এখন প্রায় চার কোটি টনের মত উত্পাদন হচ্ছে। ক্রমাগত খাদ্য ঘাটতির দেশ এখন খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ এবং বাজার মূল্য বজায় রাখতে আমাদের রপ্তানি বাজার খুঁজতে হচ্ছে।
ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে কৃষি উপখাতগুলোতে। মত্স্য, পোল্ট্রি উপখাতে ঘটেছে বাজারভিত্তিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আমাদের বন সম্প্রসারণের ব্যাপ্তিও ঘটছে দ্রুত। কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না হলেও ফসল উত্পাদন উপখাতে বৈচিত্রায়নও হচ্ছে। ফল চাষ ব্যাপক বেড়েছে, শাক-সবজির উত্পাদন এখন আর কোনো মৌসুমে সীমাবদ্ধ নেই। শাক-সবজি সারা বছরই উত্পাদন হচ্ছে। কৃষি মালিকানা কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এবং এই কারণেই চার দশকের উপর এই সময়ে কৃষি প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ক্রমান্বয়ে কৃষি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। ফসল উত্পাদনে ক্ষুদ্র কৃষক, প্রান্তিক চাষি, বর্গা চাষির হাতে এখন কৃষি উত্পাদনের দায়িত্ব নিপতিত হয়েছে। খামার আকৃতি দ্রুত কমছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে ক্ষুদ্রায়তন কৃষি খামার (০.০৫ একর থেকে ২ দশমিক ৪৯ একর) সংখ্যা ছিল ৭০ শতাংশ যা বেড়ে ২০০৮ সালে দাঁড়িয়েছে ৮৪ শতাংশ, বর্তমানে তা ৯০ শতাংশের বেশি।
ক্রমাগতভাবে বড় ও মাঝারি কৃষক রূপান্তরিত হয়েছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকে। বড় ও মাঝারি কৃষক কৃষি পেশায় থাকলেও তাদের দ্বিতীয় পা অকৃষি কার্যক্রমে জড়িত। সাতাশি ভাগ গ্রামীণ খামার কোনো না কোনো অকৃষি খাত থেকে আয়-রোজগারের সংযোগ রয়েছে। কৃষির প্রাকৃতিক ও দাম মোকাবিলার ঝুঁকি পরিহারের জন্যই হয়তো গ্রামীণ পরিবারগুলোকে অকৃষি পেশায় যেতে উত্সাহ যোগাচ্ছে।
সে সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে, গ্রামীণ সড়ক, জনপথ ও স্থানীয় বাজারগুলোতে এবং গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত্ পৌঁছে যাওয়ায়। এই সংযোগ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে গত ছয়-সাত বছরে। গ্রাম সংযুক্ত হয়েছে, উপজেলা, জেলা হয়ে রাজধানীসহ বড় বড় শহরগুলোতে এবং সেই সঙ্গে বেড়েছে বিশ্ব সংযুক্তিও। মোবাইল যোগাযোগ প্রতিটি গ্রামকে কেবল দেশের হাট-বাজার ও শহরকে একীভূত করেনি, প্রতিটি গ্রামই এখন বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত বিশ্বায়িত গ্রাম। পোশাক পরিচ্ছদ ও জীবনাচারে, এখন গ্রাম ও নগরবাসীর পার্থক্য একাকার। তবে ফসল উত্পাদনে কায়িক শ্রমের সংশ্লিষ্টতাও এখনো ব্যাপক প্রকৃতি নির্ভরতা একচ্ছত্র।
পঁয়তাল্লিশ শতাংশ শ্রমিক এখনো কৃষি পেশায় নিয়োজিত। কৃষিখাতের ভার বহন করছে এই বৃহত্সংখ্যক শ্রমিক শ্রেণি। এতেই প্রমাণিত হয় কৃষিখাতে যান্ত্রিকীকরণ প্রযুক্তির ব্যবহার ও নতুন উদ্ভাবন যথেষ্ট ঘটেনি। প্রকৃতি নির্ভরতা থেকে কৃষিকে মোটেই বের করে আনা যায়নি, যে কারণে এত বৃহত্ সংখ্যক শ্রম শক্তিকে এই কম উত্পাদিকা ও তুলনামূলক নিম্নমজুরির পেশায় থেকে যেতে হচ্ছে। জাপানে মাত্র চার শতাংশ শ্রমশক্তি সমুদয় কৃষি উত্পাদন পরিচালনা করে থাকে। নেদারল্যান্ডেও প্রায় দুই শতাংশ শ্রমশক্তি কৃষি উত্পাদনে নিয়োজিত এবং সারা ইউরোপের প্রধান কৃষি পণ্য রপ্তানিকারক দেশ।
কানাডা, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রেও কৃষি পেশায় নিয়োজিত শ্রমশক্তির সংখ্যা যথাক্রমে ২ ও ১ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রকৃতিনির্ভর কৃষি থেকে বেরিয়ে আসতে, প্রতি জমি ইউনিটে উত্পাদিকা কয়েকগুণ বাড়াতে উন্নততর প্রযুক্তি যান্ত্রিকীকরণ, টিস্যু কালচার গ্রহণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও বস্তাবন্দীকরণে অটোমেশন প্রযুক্তি গ্রহণ আমাদের প্রান্তিক চাষি, বর্গা চাষি, ক্ষুদে কৃষাণ-কৃষাণীর পক্ষে সম্ভব নয়। ভরণ-পোষণের জন্য ক্ষুদ্র কৃষক-কৃষাণী মূলতঃ ফসল উত্পাদনে জড়িয়ে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা অন্য পেশায় চলে যায় যদি গা-গতরে সামর্থ্য থাকে। কৃষি নিয়ে এই সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একান্ত ব্যক্তিখাতে পরিচালিত এই কৃষিতে, বিশেষভাবে ফসল উপ-খাতে, সরকার উপকরণ ভর্তুকি, নিম্নসুদে ঋণ, প্রশিক্ষণ সহায়তা দিয়েও কৃষিখাতের কাঠামো পরিবর্তন না হলে বর্তমানের এই ‘বীজ, সার ও পানিকেন্দ্রিক প্রকৃতিনির্ভর’ প্রযুক্তিতে উত্পাদন আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশের কৃষি ইতিহাসে আরো একটা ‘টার্নিং পয়েন্ট’ সৃষ্টিতে কৃষিখাতে এখন দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন (Paradigm shift) অপরিহার্য।
আর্থিক বছর ২০০১-০২ থেকে ২০০৫-০৬ সময়ে কৃষিখাতের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর্থিক বছর ২০১১-১২ থেকে আর্থিক বছর ২০১৫-১৬ তে গড় কৃষি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। যদিও সর্বোচ্চ কৃষি প্রবৃদ্ধির হার আমাদের দেশেই অর্জিত হয়েছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর আর ঐ প্রবৃদ্ধির হার কখনোই পাঁচ শতাংশে উন্নীত করা যায়নি।
আর্থিক বছর ২০১৫-তে কৃষি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা বিদায়ী অর্থ বছরে ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রচুর ভর্তুকি, প্রণোদনা, স্বল্পসুদে ঋণ ও প্রশিক্ষণ প্রদানে সমর্থনের কমতি নেই সরকারের। আমি মনে করি উচ্চ ফলনশীল বীজ, সার ও পানিসমন্বিত প্রযুক্তির মাধ্যমে উত্পাদন বাড়ানোর প্রান্তসীমায় (থ্রেশোল্ড লেভেলে) বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে কৃষির বিশেষভাবে ফসলখাতে একটি বড় রকমের কাঠামোগত পরিবর্তন এখন আবশ্যক। বর্তমান অর্থ বছরে শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ, সেবাখাতে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, কৃষিখাতেই কেবল ২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং সার্বিক প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ৭ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ (প্রাক্কলিত)। সাত শতাংশের উপরে যেতে পারলাম, শিল্পখাতে অর্জিত দুই অংকের প্রবৃদ্ধির কারণে।
আগামী দিনগুলোতে আশা করা যায়, শিল্প ও সেবাখাতে প্রবৃদ্ধির হার আরো বাড়বে। সমস্যা রয়ে যাবে প্রকৃতিনির্ভর কৃষিখাত (বিশেষভাবে ফসলের উপখাত) প্রবৃদ্ধি অস্থিরতা কিংবা নিম্নমুখীনতা। দেশ শিল্পায়িত হচ্ছে একথা সত্য। আমাদের দেশজ আয়ের ৩১ দশমিক ২৮ শতাংশ আসে শিল্পখাত থেকে, সেবাখাত থেকে সর্বোচ্চ ৫৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং কৃষিখাতের অবদান ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। শিল্প ও সেবাখাতের অবদান ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।
মাথাপিছু আয় বাড়াতে শেষোক্ত দুই খাতের অবদান বাড়বে। তো তারপরেও দেশ কৃষিখাতে হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় কৃষির গুরুত্ব থাকবে সর্বজনীন। নেদারল্যান্ডের আয়তন বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ, লোকসংখ্যা বাংলাদেশের এক দশমাংশ। দেশজ আয়ের ৭২ শতাংশ আসে সেবাখাত থেকে, শিল্পখাতের অবদান ২৬ শতাংশ এবং কৃষিখাতের অবদান জিডিপির দুই শতাংশ। কৃষিতে নিয়োজিত আছে শ্রমশক্তির মাত্র দুই শতাংশ। জাপানের অর্থনীতিতে সেবাখাতের অবদান ৭২ শতাংশ শিল্পখাতের অবদান ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ এবং কৃষিখাতের অবদান মাত্র দেড় শতাংশ। কৃষি উত্পাদনের হার পৃথিবীর সর্বোচ্চ। নেদারল্যান্ড শ্রমশক্তির দুই শতাংশ নিয়োজিত রেখেই ইউরোপের সর্বাধিক কৃষি রপ্তানিকারক দেশ।
আমাদের কৃষিতে নিয়োজিত আছে মোট শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশ। এত বিপুল সংখ্যক শ্রমশক্তির সংযুক্ত থাকায় মাথাপিছু উত্পাদনের হার খুবই নিম্ন এবং এটা প্রযুক্তিগত জাপান ও নেদারল্যান্ডের তুলনায় পশ্চাত্পদতার ইঙ্গিতবাহী। আমাদের কৃষি হচ্ছে এখনো নিম্ন মজুরি ও নিম্ন উত্পাদিকা খাত। উচ্চ প্রযুক্তির কৃষিতে (হাইব্রিড বীজ, জিএম বীজ, পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত গ্রীন হাউজ, ড্রিপ সেচ, টিস্যু কালচার, কাটাই ও সমন্বিত মাড়াই যন্ত্র, শুকানোর যন্ত্রের ব্যবহার) যাওয়ার মত পুঁজি ও দক্ষতা আমাদের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি, বর্গা চাষি, ক্ষুদ্র-জোত-জমার কৃষকের পক্ষে বিনিয়োগ করা অকল্পনীয়। অধিক শ্রম ও উপকরণভিত্তিক উত্পাদন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ অর্জন যা সম্ভব, সম্ভবতঃ সে স্তরে আমরা পৌঁছে গেছি।
দক্ষতাভিত্তিক, উন্নত প্রযুক্তি ও উদ্ভাবননির্ভর কৃষি কাঠামোর জন্য ক্ষুদ্রাকার খামার আকৃতি ও বিত্তহীনতা বড় বাধা। তার মানে, ব্যাপক পরিবর্তনে বড় রকম উত্পাদনশীলতার লক্ষ্যে বড় আকৃতির খামার আয়তন প্রতিষ্ঠায় এখন আমাদের উত্সাহ যোগাতে হবে। কাজী ফার্মস চা বাগান করেছে। প্রাণ, অগোরা ও স্বপ্ন কৃষি পণ্য বিপণনে অনেকদূর এগিয়েছে। তবে ফসল উত্পাদনে যেমন ধান, গম, ভুট্টা, আলু, শাকসবজি এবং কলা চাষে এখনো বড় আকৃতির খামার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কৃষি রূপান্তরিত হতে হবে ব্যবসাভিত্তিক এগ্রোবিজিনেস। কৃষি হবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা নির্ভর এবং পুরোটাই হবে বাজারভিত্তিক। কৃষি রপ্তানিতে আমাদেরকে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে। কৃষির ইতিহাসে ‘দ্বিতীয় টার্নিং পয়েন্ট সৃষ্টিতে’ দেশের সরকারি ও বিশেষভাবে বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই কৃষি ব্যবসায় বড় রকমের বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। বড় ফার্ম প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
এই রূপান্তরে সরকারকে দিতে হবে সর্বোচ্চনীতি সহায়তা। সরকার ব্লক বা উপজেলা পর্যায়ে কতিপয় কৃষি কর্মকর্তা নিয়োজিত রেখেছেন অথচ বৃহত্ খামার প্রতিষ্ঠিত হলে খামারিরাই কৃষি বিজ্ঞানীদের নিয়োগ করবে প্রতিটি খামারে। যেমন বহু বাণিজ্যিক মত্স্য খামারি, তাদের খামারে মত্স্য গ্রাজুয়েটদের উচ্চ বেতনভাতা দিয়ে পূর্ণকালীন নিয়োজিত রাখছেন। উদাহরণ গচিহাটা মত্স্য ফার্ম ও ভালুকা ও ত্রিশালের অনেক বাণিজ্যিক মত্স্য খামার। উপজেলার বেসরকারি খামারে খামারে তখন বহু কৃষি গ্রাজুয়েট নিয়োজিত থাকবে। তবে উচ্চ প্রযুক্তির রূপান্তর পর্যায়েও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক বর্গাচাষিদের বর্তমানের মতই ভর্তুকি ও মূল্য সহায়তা অব্যাহত দিয়ে যেতে হবে সরকারকে।
লেখক :সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি ও সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন
সুত্রঃ.ittefaq.com.bd/