কৃষি প্রতিক্ষন ডেস্ক : সরকারের ভুলনীতি এবং প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিপর্যয়ের মুখে পোলট্রি শিল্প। দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক পোলট্রি খামার বন্ধ হচ্ছে। এতে একদিকে মানুষের আমিষের চাহিদা বিঘ্নিত হচ্ছে, অপরদিকে হুমকিতে এ খাতের ২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। খবর যুগান্তর অনলাইনের ।
গাজীপুর : পোলট্রি রাজধানী হিসেবে খ্যাত গাজীপুর। দেশের সবচেয়ে বেশি পোলট্রি খামার রয়েছে এ জেলায়। এখান থেকে বাচ্চা উৎপাদন করে সারা দেশের খামারগুলোয় সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এ জেলায় নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করছেন না। পুরনোরাই পেশা পরিবর্তন করছেন। যারা কোনোমতে টিকে আছেন, তারাও কয়েক বছর ধরে লাভের মুখ দেখছেন না।
জেলায় নিবন্ধনকৃত ৩ হাজার ১২২টি লেয়ার মুরগির খামার রয়েছে। মাংস উৎপাদনের জন্য ব্রয়লার মুরগির খামার রয়েছে ২ হাজার ৪১৬টি। মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের হ্যাচারি রয়েছে ১৩টি, হাঁসের খামার রয়েছে ২১৭টি। এছাড়া অনিবন্ধত আরও কয়েক হাজার খামার রয়েছে। আর বিভিন্ন সংকটে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে গাজীপুরের পোলট্রি খামারগুলো। বিশেষ করে ক্ষুদ্র খামারিরা এখন অস্থিত্ব সংকটে। গত আট বছরে জেলার কয়েক হাজার খামার বন্ধ হয়ে গেছে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৭ সালে এ জেলায় প্রায় ৮ হাজার পোলট্রি খামার ছিল। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজারে। এর মধ্যেও বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে অনেক খামার। বিশেষ করে ক্ষুদ্র খামারগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। জানা গেছে, গাজীপুরে এক সময় দেশের অর্ধেক ডিম ও মাংস উৎপাদন হয়েছে। ক্রমাগত লোকসানের কারণে কয়েক হাজার পোলট্রি গুটিয়ে ফেলা হলেও এখনও দেশের এক চতুর্থাংশ ডিম ও মাংস উৎপাদন হচ্ছে গাজীপুরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশির দশকে গাজীপুরে ব্যাপক হারে পোলট্রি ফার্ম গড়ে ওঠে। শুরুতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পোলট্রি ফার্মগুলো গড়ে উঠলেও এ শিল্পে ব্যক্তিগত বিনিয়োগও বৃদ্ধি পায়। এ সময় গাজীপুরেই গড়ে ওঠে প্রায় ১৮ হাজার পোলট্রি ফার্ম। দীর্ঘ দু’দশক নির্বিঘ্নে ব্যবসা চলে। কিন্তু ২০০৩ ও ২০০৪ সালে ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে বার্ড ফ্লু সংক্রমণের চিত্র থেকেই আতংক ছড়ায়। তখন থেকেই পোলট্রি শিল্পে ধস নামে।
পোলট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মো. মোহসিন জানান, পোলট্রি ব্যবসা চলে যাচ্ছে দেশী এবং বিদেশী গুটিকয়েক বড় কোম্পানির হাতে। এছাড়া ডিমের দাম নির্ধারণ করে ঢাকার আড়তদাররা। সে অনুযায়ী তাদের বিক্রি করতে হয়। তিনি জানান, রোজার সময় ডিমের একটি বিশাল অংশ অবিক্রীত অবস্থায় থেকে যায়।
রাজশাহী : এ জেলায় প্রায় ৬ হাজার পোলট্রি খামার ছিল। নানামুখী সংকটে রাজশাহীর বিকাশমান পোলট্রি শিল্পে ধস নেমেছে। এখানেও খামারগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে সাড়ে তিন হাজার পোলট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে। প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা নেই এ খাতে। কয়েক বছরে নতুন বিনিয়োগও হয়নি। সবমিলিয়ে রাজশাহীর পোলট্রি শিল্পে বিরাজ করছে হতাশার চিত্র।
১৯৯৭ সালে পতিত জমিতে একটি পোলট্রি ফার্ম তৈরি করেন প্রকৌশলী মুনতাসীর রহমান। ২০১২ সাল পর্যন্ত সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছিল। কিন্তু ১৪ সালের শুরুতে সীমান্ত পথে চোরাচালান ও আমদানির মাধ্যমে ভারত থেকে মুরগির বাচ্চা আর ডিম আসা শুরু হয়। ফলে দেশীয় পোলট্রি বাজার হারায়। এছাড়া অব্যাহতভাবে পোলট্রি ফিডের দাম বাড়ায় কুলিয়ে উঠতে পারেননি। আর সম্প্রতি বছরগুলোতে বৈরী আবহাওয়ার কারণে পোলট্রি মুরগি বাঁচিয়ে রাখা যায়নি।
রাজশাহীর খামারিদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা গেছে, বার্ড-ফ্লু ও অব্যাহতভাবে পোলট্রি ফিডের দাম বৃদ্ধির কারণে এ শিল্পে ধস নামে। সেইসঙ্গে যারা এ শিল্পে বিনিয়োগ করেছিলেন তাদের স্বপ্ন শেষ হতে থাকে। পুঁজি হারিয়ে অনেকেই পথে বসেছেন। নানা সংকটের মধ্যেও টিকে আছে প্রায় দুই হাজার খামার। রাজশাহীর খামারিরা পোলট্রি ফিডের দাম কমানো ও ভারত থেকে ডিম ও একদিনের বাচ্চা আমদানি বন্ধের দাবি জানালেও তা কার্যকর হয়নি।
খামারিরা আরও জানান, বাজারে বর্তমানে একটি সাদা ডিম ৭ টাকা ৬০ পয়সা এবং লাল ডিম ৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু একটি ডিম উৎপাদনে খরচ হচ্ছে সাড়ে ৭ টাকা। আবার এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৩০-১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হলেও এ মুরগি উৎপাদনে ১৪০-১৫০ টাকা করে ব্যয় হচ্ছে। এভাবেই খামারিরা লোকসান গুনছেন।
যশোর : যশোর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস জানায়, যশোরের ৮ উপজেলায় মোট ১ হাজার ১৫৬টি মুরগির খামার রয়েছে। সূত্র মতে, যশোরে পোলট্রি খাতে বড় পুঁজির কাছে মার খাচ্ছে ক্ষুদ্র পুঁজির খামারিরা। বড় পুঁজির খামারিরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লেয়ার, ব্রয়লার ও পোলট্রি ফিডের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে ক্ষুদ্র খামারিদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ঋণ নিয়ে পোলট্রি খামার করে লাভের মুখ দেখতে পারছে না অধিকাংশ ক্ষুদ্র খামারি। অনেকে অব্যাহত লোকসানে বন্ধ করে দিচ্ছে।
ক্ষুদ্র খামারিরা বলছেন, এ অঞ্চলের বড় খামারিরা বাচ্চা উৎপাদন করে মুরগি ব্রয়লার ও লেয়ার করছে। তারা ইচ্ছামতো দাম বৃদ্ধি করে। আবার ইচ্ছামতো দাম কমায়। এতে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না ক্ষদ্র খামারিরা। বাজার থেকে চড়া দামে মুরগির বাচ্চা ক্রয় করা হয়। চড়া দামে বাচ্চা ক্রয় করে ব্রয়লার মাংস বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে আসল টাকা উসুল করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কৃপ্র/ কে আহমেদ/ এম ইসলাম