কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ মৌলভীবাজারের বড়লেখার গহীন অরণ্যে এবার পর্যটকদের জন্য বিনোদনের খোরাক হিসেবে সন্ধান মিলেছে ফুল ঝেরঝেরী ও ফুলবাগিচা ঝর্ণার। দীর্ঘদিন পাহাড়ের ভেতরে থাকায় ঝর্ণাগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। প্রতিবেদন নয়া দিগন্ত অনলাইন।
ঘন সবুজ অরণ্য, সুউচ্চ পাহাড় আর কান পাতলেই ঝর্নার সমধুর আওয়াজ। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের জন্য বড়লেখার পাথারিয়া পাহাড় বিখ্যাত হলেও ভরা বর্ষায় সেখানে দেখা মিলে ছোটো-বড়ো আরো কয়েকটি ঝর্ণার। প্রকৃতিপ্রেমী, ভ্রমণপিপাসু ও অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য তেমনি এক সৌন্দর্য্যরে আধার পাথারিয়ার ফুল ঢালনী ঝেরঝেরী ও ইটাহরী ফুলবাগিচা ঝর্ণা। পাথারিয়া পাহাড়ের উঁচু-নিচু টিলার পাদদেশে সবুজ বৃক্ষরাজি ও পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহমান ছড়া প্রবলভাবে আকৃষ্ট করবে দর্শনার্থীদের। ছড়ার ছোটো-বড়ো পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলধারা বিমোহিত করে আপন স্বকীয়তায়। দুর্গম এই ছড়া দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যতো বিপত্তি ও ক্লান্তিই আসুক না কেন ছড়ার স্বচ্ছ শীতল পানি, চারিদিকের সবুজ প্রকৃতি, বুনোফুল, চাষনী লেবুর সুবাস, পাখি ও ঝিঁ ঝিঁ পোকার কলতানে প্রকৃতির সুরে মিলিয়ে যাবে সব অবসাদ।
উপজেলার সীমান্তবর্তী ডিমাই বাজার থেকে বড়লেখা সদর বনবিটের আওতাধীন পাথারিয়া পাহাড়ের নির্জন পল্লী ডিমাই পুঞ্জি। এর পাশ দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি ও ছড়ার পথে হেঁটে গেলে বিভিন্ন দিক থেকে বয়ে আসা ছড়ায় প্রথমে চোখে পড়বে কয়েকটি ছোটো ঝর্ণা, তবে দৃষ্টিনন্দন।
পাহাড়ি পথ ও ছড়া দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দুইপাশের সবুজ ছায়াশীতল প্রকৃতি যে কারো নজর কাড়বে এক পলকেই। প্রায় ৬ কিলোমটিার পিচ্ছিল পাথুরে ছড়া দিয়ে হাঁটার পর এই ছোটো ঝর্ণাগুলো বেয়ে ওপরে ওঠলে দুটি টিলার ভিতরে চোখের সামনে ভেসে উঠবে অনিন্দ্য সুন্দর ঝেরঝেরী ঝর্ণা। দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার পর ক্লান্ত হলে ঝর্ণাটির শীতল জলধারায় শরীরটা ভিজিয়ে নিলে ক্লান্তি মিলিয়ে যাবে অনায়াসেই।
এই ঝর্ণার অদূরে অর্থাৎ এটির ঠিক ডানপাশে ইটাহরী ফুলবাগিচা ঝর্ণার অবস্থান। ছড়ার পথ ধরে ফুলবাগিচায় যাওয়া অসম্ভব। কারণ ফুলবাগিচার পানি প্রবাহের যে ছড়া, সেটির দুইপাশে দুটি টিলা রয়েছে। এই টিলা দুটির মধ্যখানে ছড়ার রাস্তাটি খুবই সরু। তাই এই পথে ফুলবাগিচায় পৌঁছানো যাবে না। সেখানে যেতে হলে প্রায় ৭০ ফুট উঁচু খাড়া দুটি পাহাড়ের পিচ্ছিল পথ বেয়ে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়বে ফুলবাগিচা ঝর্ণা। স্থানীয়দের কাছে এগুলো ঢালনী (ঝেরঝেরী) ও ইটাহরী ফুলবাগিচা ঝর্ণা নামেই পরিচিত। এই জলপ্রপাত থেকে আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ সীমান্তের দূরত্ব প্রায় ৩ কিলোমিটার।
পাথারিয়া পাহাড়ের আরেকটি অংশে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড। মাধবকুণ্ড ও কমলগঞ্জের কুরমা বনবিটের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত হামহামের মতো নব আবিষ্কৃত ঝর্ণাগুলো বড়ো না হলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছে মনোরম।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ঝেরঝেরী ও ফুলবাগিচার মতো পাথারিয়া পাহাড়ের এই অংশে থেকেই চোখে পড়বে ত্রিপল ঝর্ণা, যামিনীকুণ্ড, মৌলভী ঝর্ণা, জমজ ঝর্ণা ও রামাকুণ্ড নামে আরো অন্তত পাঁচটি ঝর্ণা। তবে এগুলোর বেশিরভাগই মৌসুমী ঝর্ণা। বর্ষাকালে এই ঝর্ণাগুলো যৌবনদীপ্ত হয়ে ওঠে। আর শুষ্ক মৌসুমে এগুলোর কয়েকটি শুকনো থাকে। এছাড়াও পাথারিয়া পাহাড়েরর ফুলছড়ি এলাকায় রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট নান্দনিক একটি মাটির ব্রিজ, এটি স্থানীয়দের ভাষায় মাটির পুল বলা হয়ে থাকে। এই ব্রিজটি দুটি টিলার সংযোগস্থল। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ব্রিজটির নিচ দিয়ে ছড়া প্রবাহিত। যাতায়াত ব্যবস্থার কোনো সুযোগ না থাকা, দুর্গম এলাকায় হওয়ায় এবং প্রচার-প্রচারণার অভাবে প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দয্যের প্রতীক এই ঝর্ণাগুলো দীর্ঘদিন ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে।
উপজেলা সদর থেকে অটোরিক্সা, মাইক্রো অথবা মোটর সাইকেলযোগে ডিমাই বাজারে গেলে সেখান থেকে কাঁচা পথ ধরে কিছুদূর পায়ে হেঁটে গেলো চোখে পড়বে দুর্গম পাহাড়ি পথ ও ছড়া। ছড়ার পানি যেমন স্বচ্ছ তেমনি পিচ্ছিল ছড়ার পাথরগুলোও। ছড়ার অনেক অংশে রয়েছে গভীর পানি। এছাড়াও অনেক পাথর খুবই ধারালো ও অনেক ছোটো-বড়ো বড় গর্ত রয়েছে। এসব পাথরের গর্তে পা ঢুকে গেলে পা মচকে যাওয়াসহ ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। তাই খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। পাহাড়ি পাথরগুলোও বিপদজনক।
স্থানীয় গাইড তারেক মিয়া ও সামাজিক বনায়নের বাগান মালিক সুরমান আহমদ জানান, বর্ষাকালে এই ঝর্ণা ও ছড়ায় পানি বেশি থাকে। এখানে জোঁক, বিষধর সাপ ও বিষাক্ত পোকা আক্রমণ করতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে এখানে পানির স্রোত কম থাকে। পুরো পাথারিয়ারর বুক চিরে বেশ কয়েকটি ছোটো-বড়ো ঝর্ণা রয়েছে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজ উদ্দিন জানান, পাথারিয়া পাহাড়ে আগে বাঁশমহাল ছিল। বর্তমানে সেটি সামাজিক বনায়নের আওতায় রয়েছে। সামাজিক বনায়নের আওতায় নিয়ে আসার পর বিভিন্ন বৃক্ষের পাশাপাশি ফলদ বৃক্ষ রোপণের ফলে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশেও বৈচিত্র্যতা এসেছে। প্রাকৃতিক ঝর্ণা আর ছড়া ও চারপাশে সবুজের সমারোহ দর্শনার্থীদের তাই কাছে টানে।
তিনি আরো জানান, এখানে যদি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা যায় তাহলে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আসবেন। পর্যটকরা দূর-দূরান্ত থেকে বড়লেখায় এসে শুধুমাত্র মাধবকুণ্ড ভ্রমণ করে যান। ডিমাই এলাকার ঝর্ণাগুলোর প্রতি পর্যটন কর্পোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি দেন তাহলে এখানকার ঝর্ণা উপভোগ করে দর্শনার্থীরা মুগ্ধ হবেন। এতে করে দেশের পর্যটন শিল্পের যেমন বিকাশ ঘটবে তেমনি সরকারও রাজস্ব আয় করতে পারবে। এছাড়া স্থানীয় বেকার যুবকরা পর্যটকদের গাইড হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাবে ও স্থানীয়ভাবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ফলে স্থানীয় লোকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
সম্প্রতি ছড়া দুটির সৌন্দর্য্য উপভোগে গিয়ে ফিরে এসে প্রকৃতিপ্রেমী তানিমুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, সুলতান মাহমুদ প্রমুখ এ প্রতিবেদককে জানান, আমরাও জানতাম না আমাদের এলাকার অরণ্যে এতো মনোমুগ্ধকর স্থান রয়েছে। স্থানটি আসলেই অনেক সুন্দর। তবে যাতায়াত বেশ কষ্টকর। রোমাঞ্চকরপ্রিয় প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্যে এটি একটি অন্যতম স্থান হবে বলে আমরা মনে করি। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এদিকে দৃষ্টি দিলে এখানে পর্যটক সমাগম আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে আলাপকালে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান জানান, দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে সরকার খুবই আন্তরিক। বড়লেখার পাথারিয়ার জলপ্রপাত ও সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটন স্পটগুলোকে সার্বিক ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ, পর্যটকদের সুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
কৃপ্র/ তাহেরা ইসলাম /এম ইসলাম