পাটের সুদিনকে ধরে রাখতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে
কৃষি প্রতিক্ষণ ডেস্কঃ পাটের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে প্লাস্টিকের পলিথিন। পরিবেশবান্ধব পাটের মোড়কের পরিবর্তে আইন অমান্য করে এখনো ক্ষতিকর প্লাস্টিক পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। নিজেদের স্বার্থে পরিবেশ রক্ষায় পাটপণ্য ও মোড়কের ব্যবহার বাড়ানোর মানসিকতা তৈরি করতে হবে দেশের প্রতিটি নাগরিককে। পাটের সুদিনকে ধরে রাখতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। খবর প্রথম আলো অনলাইনের।
মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘পাট উৎপাদন ও পাটজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা। বৈঠকে পাটের বিভিন্ন সম্ভাবনাময় দিক, বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাধা ও সমস্যা এবং সমস্যার সমাধান তুলে ধরা হয়। উন্নত মানের পাট উৎপাদনে চাষিদের ভালো মানের বীজ, সার ও কীটনাশক বিতরণে প্রণোদনা দেওয়ারও পরামর্শ দেন বক্তারা। পাট বাজারজাতকরণ ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার ওপরও জোর দেন তাঁরা।
কেয়ার বাংলাদেশের সহযোগিতায় প্রথম আলো আয়োজিত এ বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম। বৈঠকে সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বৈঠকে পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, আগামী মাসে পাট নীতিমালা মন্ত্রিসভায় পাস হবে। পাটের বিস্তার ও বহুমুখী উৎপাদনে এ সরকার খুবই আন্তরিক। পাটের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি—এ ছয়টি পণ্যে পাটের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বর্তমানে ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট-২০১০’-এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে বেড়েছে পাটের ব্যবহার। মানুষের আন্তরিকতায় এক মাসের মধ্যে এ কার্যক্রম সফল হয়েছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া বিগত সরকারগুলোর আমলে পাট কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। উল্টো বন্ধ করা হয়েছে পাটকল। বেকার হয়েছেন হাজারো শ্রমিক। বর্তমান সরকার পাটের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। বহুমুখী পাটপণ্য তৈরি করে রপ্তানি আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে ৭০০ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা দেওয়া হবে। এ ছাড়া উন্নত মানের যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পাটের শত্রু হিসেবে পলিথিনের কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, বর্তমানে পাটের বড় শত্রু প্লাস্টিক পলিথিন প্যাকেট। প্লাস্টিক পণ্য প্রস্তুতকারীরা আইন মানছেন না।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘দেশের পাট খাত আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই সুদিন ধরে রাখতে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে নতুন ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাট চাষে সফলতা তুলে ধরে কেয়ার বাংলাদেশ। এ সংস্থাটি দেশের চারটি জেলায় পাট উৎপাদনকারীদের সহযোগিতা করছে। সে সময় কেয়ার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর জেমি টার্জি বলেন, পাট পরিবেশের বন্ধু, আর তাই পাটের সঠিক উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন।
বৈঠকে মো. আলী হোসেন নামে রংপুরের এক পাটচাষি পাট উৎপাদনে কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তা তুলে ধরেন। তিনি জানান, তাঁর পরিবার বহু বছর ধরে পাট চাষের সঙ্গে জড়িত। তবে নিজে সম্পৃক্ত হওয়ার পর দেখলেন বীজের শোধন বোঝেন না তিনি। এখন কেয়ারের সহযোগিতায় এ বিষয়ে ধারণা পেয়েছেন। রংপুরে পানির অভাব ছিল। ‘রিবন বেটিং’ পদ্ধতি ব্যবহারে সে সমস্যা দূর হয়েছে। তবে বর্তমানে যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, তা হলো পাটের বাজারজাতকরণ। তিনি বলেন, কৃষকেরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে। পাট চাষে সরকারি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সময়ে বিভাজন, ষড়যন্ত্রের কারণে ধ্বংস হয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এ খাত। চার কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ খাতে জড়িত। এ খাতকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন বাংলাদেশ জুট মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) সচিব এ বারিক খান। তিনি বলেন, তুলা আমদানির ওপর যেমন ২ শতাংশ হারে ঋণ প্রদান করা হয়; তেমন সুবিধা পাটের ক্ষেত্রেও দিতে হবে। এ ছাড়া পলিথিন উৎপাদন করা হলেও তা শতভাগ রপ্তানিমুখী করতে হবে। ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ বাস্তবায়নের প্রশংসা করেন তিনি।
বৈঠকে বাজার সম্প্রসারণের কথা বলেন বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) সাবেক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল হুমায়ুন খালেদ। তিনি বলেন, বিশ্বে এবং দেশের অভ্যন্তরেও পাটের চাহিদা এখন অনেক। এ জন্য বাজার সম্প্রসারণ প্রয়োজন। পাট বিক্রির প্রক্রিয়াতে পরিবর্তন আনতে হবে। পাটের বিকাশে প্লাস্টিকের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বৈঠকে কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক (ইআরপিপি) আনোয়ারুল হক বলেন, বর্তমানে কৃষকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ভালো বীজ পাওয়া। ৩৩ ভাগ চাষি ভালো বীজ পাচ্ছেন। ৬৬ ভাগই পাচ্ছেন না। তাঁদের নির্ভর করতে হচ্ছে ভারতীয় বীজের ওপর। বীজের সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, পাটের বহুমুখীকরণে ভালো আঁশ প্রয়োজন। দেখা যায়, বেশির ভাগ ভালো আঁশ ভারতে রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়া পাটপণ্য ব্যবহারে আগ্রহ সৃষ্টিতে পাটজাত পণ্যের নকশায় আধুনিকতা আনা প্রয়োজন। বিদেশি ক্রেতারা কী ধরনের পণ্য চাইছে, তা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। তিনি পাটনীতির দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন।
কাঁচামাল সমস্যা, আধুনিক নকশা ও যন্ত্রপাতির অভাব এবং অর্থসংকট পাটের বহুমুখী উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে মনে করেন রংপুরের পায়রাবন্দ এলাকায় পাটপণ্য উৎপাদনকারী মোসাম্মৎ ফেন্সি বেগমও। তিনি বলেন, উৎপাদনকারীদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। একজন ভালো কর্মীই পারেন ভালো মানের পণ্য তৈরি করতে। ছোট ছোট উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর পণ্যের মান ভালো হলে বিদেশি ক্রেতারাও বেশি আগ্রহী হবে।
বৈঠকে সুইচ টু জুট কনসোর্টিয়ামের সভাপতি সান্ত্বনা মোমতাজ বলেন, ১৬ কোটি মানুষের ভালোবাসা রয়েছে পাটকে ঘিরে। বাংলাদেশের মতো পাট কোথাও হয় না। পাট চাষে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য তথ্যকেন্দ্র, নকশা উন্নয়ন কেন্দ্র তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
উৎপাদন থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে কয়েকটি বিষয়ের ওপর লক্ষ রাখার কথা বললেন কেয়ার বাংলাদেশের সুইচ এশিয়া জুট ভ্যালু চেইন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের টিম লিডার শেখর ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘পাটনীতি ২০১৪-এর দ্রুত বাস্তবায়নের পাশাপাশি সুদের হার নমনীয় করতে হবে। সরকারি পর্যায়ে সরাসরি পাট কেনা হলে কৃষকেরা লাভবান হবেন। তিনি আরও বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে আমাদের ঘাটতি খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্য তথ্যকেন্দ্রের ওপর জোর দিতে হবে। একটি সমন্বয় কাঠামো তৈরি করা গেলে সমস্যার দ্রুত সমাধান সম্ভব।’
তবে পাটের বর্তমান অবস্থা সন্তোষজনক বলে মনে করেন জেপিডিসির নির্বাহী পরিচালক নাসিমা বেগম। তিনি বলেন, পরিবেশ আন্দোলন চলছে সারা বিশ্বে। আর পাটই হতে পারে এ আন্দোলনের বিকল্প। দেশের ভেতরে দৈনন্দিন সব কাজে পাটপণ্য ব্যবহারের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া বিদেশে পাটপণ্যের প্রচারের জন্য কূটনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
বৈঠকে পাটপণ্যের আধুনিকায়নের ওপর নজর দেওয়ার কথা বলেন ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল করিম। তিনি বলেন, পাটশিল্পের উন্নয়নে ১৫ থেকে ২০ বছরের একটি কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে।
তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণকে বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করেন বিজেএমসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শামস-উজ-জোহা। তিনি বলেন, এ খাতের উন্নয়নে বর্তমান সরকার অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে সেগুলো বাস্তবায়নে অনেক বেশি সময় লাগে।
বৈঠকে পাটপণ্য উদ্যোক্তাদের ভিসা প্রদান বিষয়টি সহজ করার আহ্বান জানান জনতা জুট মিলস ও বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হক। তিনি বলেন, দেশি বিদেশি বিভিন্ন এসএমই মেলায় পাটপণ্য নিয়ে অংশ নিতে হবে।
ঋণ দেওয়ার শর্ত সহজ করা হচ্ছে উল্লেখ করে এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক এম এম শাহীন আনোয়ার জানান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জেনে পাটপণ্যসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদনে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হচ্ছে।
পাটশিল্পের উন্নয়নে নতুন তহবিল গঠন করা প্রয়োজন বলে বৈঠকে জানান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিচালক (পণ্য) মো. আবদুর রউফ।
বৈঠকে নতুন পণ্য উৎপাদনে গবেষণার ওপর জোর দিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের উপসচিব তপন কুমার নাথ।
এ ছাড়া পাটচাষিদের জন্য উন্নত মানের বীজ, সার ও কীটনাশক বিতরণে প্রণোদনা-ব্যবস্থা চালু করতে বলেন পাট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব নারায়ণ চন্দ্র সরকার।
কৃপ্র/ এম ইসলাম